পানুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে চলছে ক্লাস। নিজস্ব চিত্র
অবসর নেওয়ার পরেও টানা ১৭ বছর ধরে স্বেচ্ছা পাঠদান করে চলেছেন শিক্ষক। সদাইপুর থানার সিউড় গ্রামের বাসিন্দা ওই শিক্ষকের নাম বিশ্বনাথ মণ্ডল। তিনি স্থানীয় পানুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।
স্কুল এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সময় ওই স্কুলে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ানো হত। তার পরে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সিউড়ি কিংবা দুবরাজপুরের স্কুলে পড়তে যেতে হত। এর ফলে পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের প্রবণতা ছিল। বিশেষত, ষষ্ঠ শ্রেণির পরে মেয়েদের পড়াশোনা থমকে যেত। বিশ্বনাথবাবুকেও ষষ্ঠ শ্রেণির পরে বাইরের স্কুলে পড়তে যেতে হয়। নিজেকে দিয়েই সমস্যা উপলব্ধি করেছিলেন। সেই তাগিদ থেকে আরও কয়েক জন শিক্ষানুরাগীর সঙ্গে ১৯৭৫ সালে ওই স্কুলেই স্বেচ্ছাশ্রমে জুনিয়ার হাইস্কুল তথা সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণির পঠনপাঠন চালু করেন।
১৯৭৮ সালে জুনিয়র হাইস্কুলের অনুমোদন মেলে। বিশ্বনাথবাবুও ভাষা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত পান। তার পরে স্কুল মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়েছে। সেই স্কুল থেকেই ২০০৩ সালে সরকারি ভাবে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু, বাস্তবে অবসর আর নেওয়া হয়নি তাঁর। শিক্ষকের ঘাটতি মেটাতে আজও নিয়মিত স্কুলে হাজির হন তিনি।
শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ৫৬৪ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য ওই স্কুলে শিক্ষক বরাদ্দ রয়েছেন ১৪ জন। চারটি পদ দীর্ঘ দিন শূন্য রয়েছে। তার মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে সংস্কৃত পড়ানোর কোনও শিক্ষক নেই। বিশ্বনাথবাবুই ভরসা। প্রধান শিক্ষক গৌতম সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘শুধু উচ্চ মাধ্যমিকের সংস্কৃত পড়ানো নয়। বিশ্বনাথবাবু আছেন বলে আমাদের কোনও শিক্ষকের অভাব বোধ করতে হয় না। কোনও দিন কোনও শিক্ষক গরহাজির থাকলে তাঁর ক্লাসও উনি নেন।’’
একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া মণ্ডল, স্বাতী মণ্ডল, নবম শ্রেণির তিথি মণ্ডল, প্রেমতোষ ঘোষরা জানায়, বিশ্বনাথবাবুর জন্য তাঁদের কোনও ক্লাস ফাঁকা যায় না। ওদের কথায়, ‘‘যে বিষয়ের ক্লাসই নেন, মনে হয় যেন উনি সেই বিষয়েরই শিক্ষক।’’ অভিভাবক বাপী মণ্ডল, কৃষ্ণচন্দ্র পালেরা মনে করেন, ‘‘আজকের দিনে বিশ্বনাথবাবুর মতো ছাত্রদরদী শিক্ষক সচরাচর দেখা যায় না। অবসর নেওয়ার পরেও স্বেচ্ছা পাঠদান করছেন।’’
বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় আধ কিমি। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে রেখার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ছেলে রামকুমার টিউশনি করেন। ছোট তরুণ ঠিকাদারি করেন। সকাল ৯টা থেকে স্কুল যাওয়ার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় বিশ্বনাথবাবুর। খাওয়া-দাওয়া করে সাইকেল নিয়ে রওনা দেন স্কুলে। স্ত্রী উর্মিলাদেবীর কথায়, ‘‘কোনও দিন এক চুল দেরি হওয়ার উপায় নেই। অবসর নেওয়ার আগেও যেমন ওঁকে সময়ে স্কুলের ভাত দিতে হত, এখনও তার অন্যথা হয় না।’’
আর বিশ্বনাথবাবু বলছেন, ‘‘স্কুলটাকে চোখের সামনে গড়ে উঠতে দেখেছি। তাই শিক্ষকের অভাবে ক্লাস হবে না মন থেকে মানতে পারিনি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিব্যি সব ভুলে থাকি। টানা ছুটি থাকলে স্কুলের জন্য মন টানে।’’ স্কুল পরিচালন সমিতির সভাপতি প্রণবকুমার দত্ত জানান, শুধু শিক্ষকের ঘাটতি পূরণ নয়। বিশ্বনাথবাবু তাঁদের কাছে অভিভাবকের মতো। স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর মতামত নানা ভাবে স্কুলকে সমৃদ্ধ করে।