ঘটনাস্থল: মড়ার গ্রামের কাছে জাতীয় সড়কের ধারের খেতে। নিজস্ব চিত্র
ছুটে আসা দু’টি ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কায় ভয়াবহ আগুন লেগে গেল। জ্বলন্ত ট্রাকের কেবিনে আটকে ঝলসে মৃত্যু হল দুই চালক-সহ চার জনের। শনিবার রাত প্রায় পৌনে ১টা নাগাদ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থানার ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে, মড়ার চাতাল মোড় এলাকায়। দমকলের দু’টি ইঞ্জিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় দু’টি ট্রাকের আগুন নেভায়।
পুলিশ জানায়, অ্যাসবেস্টর্স বোঝাই ট্রাকের ভিতরেই চালক তপন মাহাতো (৩১), খালাসি শঙ্কর মাহাতো (৪৫) ও ট্রাক মালিকের আত্মীয় রাজেশ মাহাতোর (২৬) ঝলসানো দেহ মেলে। তাঁদের তিন জনেরই বাড়ি খড়্গপুর থানার পাটনা গ্রামে। পাথরকুচি বোঝাই ট্রাকের ভিতরেও চালক রবিউল চৌধুরীর (৪২) দেহ উদ্ধার করা হয়। বীরভূমের সদয়পুর থানার সগর গ্রামে তাঁর বাড়ি।
বিষ্ণুপুর দমকল কেন্দ্রের ওসি পঙ্কজ চৌধুরী বলেন, ‘‘দু’টি ট্রাকের সংঘর্ষের জেরে তেলের ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গিয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। সে কারণেই শনিবার রাত ১টা ১০ থেকে রবিবার সকাল প্রায় সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত আগুন নেভাতে সময় লাগে।’’
এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) প্রিয়ব্রত বক্সী বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও দমকল কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু আগুন ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছিল। আগুন নিভিয়ে দেহগুলি উদ্ধার করে ময়না-তদন্তে পাঠানো হয়েছে।’’ তিনি জানান, দুর্ঘটনার জেরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে বাঁকুড়া থেকে খড়্গপুর বা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে দুর্গাপুরগামী নিট পরীক্ষার্থীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেন পুলিশ কর্মীরা।
কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?
ঘটনাস্থলের কাছেই হোটেল রয়েছে বিকাশ ঘোষের। তিনি বলেন, ‘‘সবে ঘুমোতে যাব। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দ শুনে বাইরে এসে দেখি রাস্তার উপরে দু’টি ট্রাক দাউ দাউ করে জ্বলছে। একটি রাস্তার উপরে। অন্যটি ট্রাকটির মুখ রাস্তার পাশে ধান জমিতে মাটিতে গেঁথে গিয়েছিল। ভিতরে কেউ আছে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। আগুন হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছিল। একের পর এক টায়ার ফাটছে দেখে কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি।’’ তিনিই ভিলেজ পুলিশের মাধ্যমে থানা ও দমকলে খবর পাঠান।’’ ততক্ষণে গ্রামবাসীও জড়ো হন। কিছু পরেই আসেন পুলিশ ও দমকল কর্মীরা।
পুলিশ জানিয়েছে, পাথর কুচি নিয়ে ট্রাকটি বীরভূম থেকে খড়্গপুর যাচ্ছিল। অন্য দিকে, অ্যাসবেস্টর্স নিয়ে খড়্গপুর থেকে পুরুলিয়া যাচ্ছিল অন্য ট্রাকটি। কোনও কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এই দুর্ঘনাটি ঘটেছে বলে পুলিশের অনুমান।
পুলিশ ট্রাকের নম্বর দেখে মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রাতেই বীরভূমের ট্রাক মালিককে খবর দেওয়া হয়। এ দিন সকালেই বীরভূমের সদয়পুর থেকে বিষ্ণুপুরে চলে আসেন মৃত চালক রবিউল চৌধুরীর পরিজনেরা। তাঁর সম্পর্কিত ভাই রাজা শেখ বলেন, “দাদাই পরিবারের এক মাত্র রোজগেরে সদস্য। এখন দুই ভাইপো ও এক ভাইঝিকে নিয়ে বৌদি কী ভাবে সংসার চালাবে, জানি না। সংসারটা ভেসে গেল।’’
তবে অন্য ট্রাকের মৃতদের পরিচয় উদ্ধার করতে পুলিশের কিছুটা সময় লেগে যায়। বিকেলে খড়্গপুর থেকে বিষ্ণুপুর হাসপাতালের মর্গে তাঁদের পরিজনেরা এসে পৌঁছন। মৃত রাজেশের মামা হেমন্ত মাহাতো বলেন, ‘‘রাজেশ ইঞ্জিনিয়ার। জামসেদপুরে একটি সংস্থার চাকরি করত। লকডাউনে বাড়ি ফিরেছিল। বাড়িতে বসে থাকতে ভাল না লাগায় সে ট্রাকে পুরুলিয়া থেকে ঘুরে আসতে চেয়েছিল। এমন পরিণতি হবে কে জানত!’’ তিনি জানান, তাঁদের পড়শি মৃত তপনের বাড়িতে সাত মাসের ছেলে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নূর ইসলাম মণ্ডল, নজরুল বায়েন, আব্দুল হামিদ গাজির আক্ষেপ, ‘‘দুর্ঘটনার পরে প্রায় এক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আগুন যে ভাবে ছড়িয়েছিল, এত মানুষ জড়ো হয়েও চার জনকে উদ্ধার করে আনতে পারলাম না।’’