সিএবি-র প্রতিবাদে বহরমপুর মোহনা বাসস্ট্যান্ড চত্বরে বিক্ষোভ। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
এনআরসি নিয়ে অস্বস্তি ছিলই, বুধবার রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব বিল পাশ হওয়ার পরে সেই আতঙ্কে দোসর হয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইন।
সংখ্যালঘু প্রভাবিত মুর্শিদাবাদ জেলায় সেই জোড়া আতঙ্ক শুক্রবার সকাল থেকে নেমে এল রাস্তায়। জাতীয় সড়ক অবরোধ, রেলপথে টায়ার জ্বালিয়ে ট্রেন রুখে দেওয়া, প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ভাঙচুর, শহরে-গঞ্জে গ্রামীণ রাস্তায় দিনভর নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী মিছিল— শুক্রবার, সারা দিন উত্তপ্ত থাকল মুর্শিদাবাদ জেলা।
সেই আতঙ্কে যোগ হয়েছে একটি মৃত্যুর ঘটনাও। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন কুদরত শেখ (৫৭)। বাংলাদেশ সীমান্তের ফুলশহরী গ্রামে ওই চা বিক্রেতার মৃত্যুর পিছনে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আতঙ্ককেই দায়ী করছে তাঁর পরিবার।
নিতান্তই হতদরিদ্র ওই গ্রামে চায়ের দোকান ছিল কুদরতের। দোকানেই টিভি, দিনভর চলছে খবর। তাঁর ছেলে আপেল শেখ বলছেন, ‘‘দিনভর ওই টিভির দিকেই তাকিয়ে খবর দেখতেন আব্বা। চায়ের দোকান লাটে উঠেছিল। যে দোকান সন্ধে থেকে গমগম করত, মাঝ বিকেলেই তা বন্ধ করে ঘরে ফিরে খালি বিড়বিড় করতেন, ‘‘এ বার সাত পুরুষের ভিটে ছাড়তে হবে রে!’’
আরও পড়ুন: অনেক জনপ্রতিনিধি ‘নাগরিক’ নন: দিলীপ
বৃহস্পতিবার রাতে ঘরে ফিরেই তিনি ছেলেদের কাছে জানতে চান, ‘বাড়ির দলিলপত্র কিছু পেলি রে’! ছেলেরা তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘এত চিন্তার কিছু নেই, যা হবার সকলের এক সঙ্গেই তো হবে’! আপেল বলেন, ‘‘এর পরেই আব্বা হঠাৎ বুক চেপে বসে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান।’’
ফুলশহরী গ্রামের অদূরেই জাতীয় সড়কের উপরে উমরপুর। শুক্রবার, জেলায় বিক্ষোভের শুরু এখান থেকেই। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, উমরপুরের লাগোয়া বরোজ গ্রাম থেকে হাজার পাঁচেক গ্রামবাসীর একটি মিছিল বেরোয় এ দিন সকালে। উমরপুরে সে মিছিল আসার পথে মিঞাপুরে বিজেপি কার্যালয়ে ইট বৃষ্টির পরে মিছিল এসে পৌঁছয় উমরপুর মোড়ে। তার পরে জাতীয় সড়কের উপরে বিভিন্ন জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে দিনভর চলে বিক্ষোভ। দূরে দাঁড়িয়ে জনা কয়েক পুলিশকর্মীর তা ‘পর্যবেক্ষণ’ করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। তবে বেলা বাড়লে সেই বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আশপাশের গ্রামে। এই সময়ে খবর আসে, ধুলিয়ানে রেললাইনের উপরে টায়ার জ্বালিয়ে রুখে দেওয়া হয়েছে ট্রেন। পুলিশ পৌঁছেও আস্ফালন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। জঙ্গিপুর স্টেশনেও বিক্ষোভকারীদের সামনে থমকে যায় একটি মালগাড়ি।
বিকেল থেকে আসতে থাকে একের পর এক ট্রেন অবরোধের খবর। জেলার অন্য প্রান্ত বেলডাঙা স্টেশনেও শুরু হয়ে যায় তাণ্ডব। ফলে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল থমকে যায়। প্ল্যাটফর্মে দোকানপাট গুঁড়িয়ে, স্টেশন মাস্টারের অফিসে ভাঙচুর চালিয়ে বেলডাঙা স্টেশনেও লাইনে বসে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। ডোমকলের বিভিন্ন জায়গা থেকেও একই ভাবে নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী জনরোষ আছড়ে পড়ে রাস্তায়, গ্রামের পথে। অবরোধ কর্মসূচি না থাকলেও ডোমকল বাজারে বিক্ষোভকারীদের ভিড়ে কার্যত অবরোধের চেহারা নেয় রাস্তাঘাট। ডোমকল-হরিহরপাড়া সড়কের উপরে গঙ্গাধারী সেতুর উপরে বসে পড়েন হাজার কয়েক মানুষ। মিছিলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জেলা
সদর বহমপুরও। স্তব্ধ হয়ে যায় বাসস্ট্যান্ড থেকে ভাকুড়ি। উত্তরপাড়া এলাকায় উত্তেজিত বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুরও চালায় বলে পুলিশের অভিযোগ। সন্ধ্যায় জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা অবশ্য বলেন, ‘‘উত্তেজনা থাকলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। তবে জেলার সব স্তরের সরকারি অফিসারদেরই সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’’