সরকারি বাসে যাত্রীদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র
বেসরকারি বাস কবে নামবে রাস্তায় তা এখনও স্পষ্ট হল না। মঙ্গলবারও কসবায় রাজ্য পরিবহণ দফতরে সরকারি কর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বাস-মিনিবাস সংগঠনের বৈঠক হয়। কিন্তু, কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। বাস মালিকদের বক্তব্য, সরকার যে ভাবে বলছে, সে ভাবে বাস চালাতে গেলে পকেট থেকে টাকা দিতে হবে। অন্য দিকে যাত্রীদের ঘাড়ে বাড়তি ভাড়ার চাপ ফেলতে রাজি হচ্ছে না সরকারপক্ষও। শেষমেশ চলতি জটিলতা কাটানোর উপায় বের করতে, বাসমালিকদের সব সংগঠনকে নিয়ে একটা রেগুলেটরি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। কমিটিতে থাকবেন পরিবহণ দফতরের কর্তারাও। ওই কমিটি পর্যালোচনা করে রাজ্যকে রিপোর্ট দেবে।
১ জুন থেকে আনলক পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় বেরোতে শুরু করে দিয়েছেন বহু মানুষ। লোকাল ট্রেন, মেট্রো বন্ধ। এ অবস্থায় কলকাতা আর শহরতলিতে এখন বেশি দূরত্বের যাতায়াতে ভরসা সরকারি বাস। কিন্তু আনলকডাউন প্রক্রিয়ার প্রথম দু’দিনেই দেখা যাচ্ছে, যাত্রীদের ভিড় সামলানোর মতো সরকারি বাস নেই। কখনও বাসের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত। মরিয়া যাত্রীদের অনেকে বিধিনিষেধ ভেঙে ভিড় করেই উঠে পড়ছেন বাসে। অনেক বাসেই সাধারণ সময়ের মতো বহু যাত্রীকে ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। পাদানিতে ঝুলে যাওয়ার ছবিও মিলছে শহরের রাস্তায়।
এ অবস্থায় বেসরকারি বাস নামাটা এই ভিড় সামলানোর জন্যই ভীষণ দরকার। কিন্তু ভাড়ার জটিলতায় তা আটকেই রইল এখনও। বেসরকারি বাস-মিনিবাস পথে না নামলে পরিস্থিতি যে সামাল দেওয়া যাবে না, তা মেনে নিচ্ছেন সকলেই।
প্রথমে ২০ জন, পরে আসন সংখ্যার সম পরিমাণ যাত্রী নিয়ে বাস চালানো যাবে বলে অনুমতি দেয় রাজ্য। তবে পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী জানিয়েছেন, ‘‘সঙ্কটময় সময় চলছে। এই মুহূর্তে আমরা ভাড়া বাড়ানোর কোনও সিদ্ধান্তই নেব না। অন্য যে কোনও সাহায্য করতে আমরা রাজি আছি।’’
কিন্তু জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেট, ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, মিনিবাস অপারেটরস কো-অর্ডিনেশন কমিটি, ইন্টার অ্যান্ড ইন্ট্রা রিজিয়ন বাস অ্যাসোসিয়েশন— সবার দাবি একটাই, ভাড়া বাড়াতে হবে। তাদের মতে, একটি বাস পথে নামলে নানা ধরনের খরচ থাকে। অল্প সংখ্যক যাত্রী নিয়ে সেই খরচের ধারেকাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন: মে মাসে কাজে যোগ দিয়েছেন ২ কোটির বেশি মানুষ, আশা জাগাচ্ছে সমীক্ষা রিপোর্ট
কোন খাতে কী রকম খরচ, তারও একটা হিসাব দিচ্ছে সংগঠনগুলি। প্রথমত, বাস চালানোর জ্বালানির খরচ। কলকাতা থেকে যে সব রুটে বাস চলেছে, তাতে দিনে ৩ থেকে ৪টি ট্রিপ হয় (যাওয়া-আসা নিয়ে মোট ৬-৮ বার)। এ জন্য ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকার ডিজেল লাগে। এর পর চালক এবং কনডাক্টরের কমিশন। টিকিট বিক্রির উপর কমিশন চালকের ১৫ শতাংশ এবং কনডাক্টরের ৯ শতাংশ কমিশন থাকে। লকডাউনের আগে পর্যন্ত চালক-কন্ডাকটরের জন্য ব্যয় হয় প্রায় দেড় হাজার টাকা। বাস রাস্তায় নামার আগেই প্রতিটি সিন্ডিকেটে দৈনিক ১৫০-২০০ টাকা জমা দিতে হয়। ওই টাকা পুজোর বোনাস থেকে শুরু করে নানা ধরনের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদিন ওই টাকা দিতে হয় বাস মালিকদের। তার উপর কলকাতায় বেশির ভাগ বাস-মিনিবাস ভাড়া করা টায়ারে চলে। দিনপ্রতি টায়ার বাবদ খরচ ৩০০ টাকা। এ ছাড়া বাসের বিমা রয়েছে। তার জন্য বছরে প্রায় ৭০ হাজারের কাছাকাছি খরচ। বেশির ভাগ মালিকই ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে বাস কেনেন। সেই বাবদ ইএমআই ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। সংগঠনগুলোর দাবি, এই খরচও জুড়তে হয় প্রতি দিনের হিসাবে।
আরও পড়ুন: লকডাউনেই ‘বিপ্লব’, অনলাইনে পলিটব্যুরো
এই সব খরচ মিলিয়ে দিন প্রতি যা দাঁড়ায়, সব আসনে যাত্রী নিয়েও পুরনো ভাড়ায় তা তোলা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়— এমনটাই দাবি সংগঠনগুলোর। কেন? তাদের দাবি, সরকারি নিয়মে বাস নামালে কলকাতা শহরে ৩৯টি আসন আছে। দিনে মোটামুটি ৩ থেকে ৪টি ট্রিপ হয়। সেই হিসাবে গড়ে ১৮০০ থেকে ২০০০ হাজার টাকা আয় হবে। খুব বেশি হলে আড়াই হাজার। তাদের যুক্তি, প্রতি দিন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ দৈনিক ক্ষতি অন্তত ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটের তরফে তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা সব দিক খতিয়ে দেখেই বলছি, বাসের ভাড়া বাড়াতেই হবে। যদি সরকার ভর্তুকি দেয়, তা হলে তো কোনও কথাই নেই। না হলে পরিবহণের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা না খেতে পেয়ে মরবেন। লকডাউনের অনেক আগে থেকেই আমরা ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি। এ বার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি মুখ্যমন্ত্রী ও পরিবহণ মন্ত্রীকে।