এক্কেবারে সিনেমার কায়দা!
নিপুণ কারিগরিতে নকল চাবি হাতের মুঠোয়। চাদর-গামছা দিয়ে বানানো দড়িও মজুত! সেলের তালা খুলে পাঁচিল ডিঙিয়ে ধা হওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা!
শেষমেশ হল না। বাদ সাধল টর্চের এক ফালি আলো। সেই আলোর সূত্রেই বমাল ধরে পড়ে গেল প্রেসিডেন্সি জেলের দুই জাঁদরেল কয়েদি— মাওবাদী দীপককুমার ও ডাকাতির আসামি শামিম হাওলাদার। কারারক্ষীদের তৎপরতায় তাদের পালানোর ছক বানচাল হলেও রবিবার রাতের ঘটনাটির দায় কারা প্রশাসনের ঘাড়েও বর্তাচ্ছে। জেল পালানোর বিবিধ সাজ-সরঞ্জাম, বিশেষত গারদের চাবির মাপ বন্দির হাতে এল কী করে, প্রকট হয়ে উঠেছে সেই প্রশ্ন। পুলিশ তদন্তে নেমেছে।
ঠিক কী ঘটেছিল? জেল-সূত্রের খবর: রবিবার রাত একটা নাগাদ দু’নম্বর সেলের ভিতর দিয়ে একটা নীল আলোর রেখা কারারক্ষী সজল মিত্রের নজরে আসে। তাঁর সন্দেহ হয়। দু’নম্বর সেলের সামনে গিয়ে রক্ষীরা দেখেন, শামিম সেলের তালা খুলতে ব্যস্ত! দাঁতে চেপে ধরেছে টর্চওয়ালা একটা লাইটার। গারদের ফাঁক দিয়ে বার করা এক হাতে আয়না, অন্য হাতে চাবি। তালার সামনে আয়না ধরে তালার ফুটোর প্রতিবিম্ব দেখে সেখানে চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করছে!
ওই অবস্থায় কারারক্ষীরা তাকে ধরে ফেলেন। জেরার মুখে শামিম কবুল করে, দীপকও চক্রান্তে সামিল। ৩৩ নম্বর সেলে গিয়ে দীপককে ধরা হয়। তাদের হেফাজত থেকে নকল চাবি ছাড়াও দড়ি উদ্ধার হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত অগস্টে আলিপুর জেলের যে তিন বন্দি পাঁচিল টপকে চম্পট দিয়েছিল, শামিম তাদের অন্যতম। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ডাকাতির মামলায় অভিযুক্ত যুবকটি ক’দিনের মধ্যে ফের ধরা পড়ে। সেই ইস্তক শামিমের ঠিকানা প্রেসিডেন্সি জেল। মাওবাদী দীপক ধরা পড়েছে ২০১২-য়। এসটিএফের দাবি, কলকাতার কাছে একটা লেদ কারখানায় যন্ত্রাংশ জুড়ে রকেট লঞ্চার তৈরির মূল কারিগর সে-ই। দীপক-সহ ৬ সন্দেহভাজন মাওবাদীকে পরে এনআইএ হেফাজতে নেয়।
কারা-সূত্রের খবর: অভিজ্ঞতা ও কারিগরি দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এই দুই ‘পাকা মাথা’ যথেষ্ট কুশলী ছক কষেছিল। জেরার মুখে তারা বলেছে, সাবানের উপরে সেলের চাবির ছাপ নেওয়া হয়েছিল। নানা জায়গা থেকে ও জঞ্জাল হাতড়ে জড়ো করেছিল বিস্তর লোহার টুকরো, তার, ব্লেড ইত্যাদি। সেগুলো মাপ মতো কেটে-কুটে তেজি আঠায় জুড়ে বানানো হয়েছিল নকল চাবি। এবং সেই চাবি পরীক্ষা করে কারা-কর্তারা রায় দিয়েছেন, তা দিয়ে সেলের তালা খুলে ফেলা মোটেই অসম্ভব ছিল না। ‘‘রকেট লঞ্চার বানাতে যে ওস্তাদ, চাবি বানানো তো তার বাঁ হাতের খেল্!’’— মন্তব্য এক আধিকারিকের।
দেওয়াল টপকানোর বন্দোবস্তেও ‘উদ্ভাবনী’ মস্তিষ্কের ছাপ। বাগানের বেড়া থেকে লোহার বড় বড় আংটা, পাত খুলে হুক তৈরি হয়েছে। বেশ কিছু গামছা, চাদরে শক্তপোক্ত গিঁট বেঁধে-বেঁধে লম্বা দড়ি বানিয়ে ডগায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেই হুক। যা কিনা ছুড়লে পাঁচিলের মাথায় খাপে খাপে আটকে যাবে। দড়ি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল দীপকের সেলে।
কারা-সূত্রের খবর, দড়িটাও যথেষ্ট মজবুত ভাবেই বানানো। ছিঁড়ে পড়ার সম্ভাবনা বিশেষ ছিল না। কথা ছিল, শামিম নিজের সেলের তালা খুলে দীপককেও বার করে আনবে নকল চাবি দিয়ে। দড়ি বেয়ে উঠে পড়বে পাঁচিলের মাথায়। তার পরে ও-পারে ঝাঁপ দিয়ে পগার পার হবে।
শেষ মুহূর্তে টর্চের আলোয় পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেলেও কারা-কর্তৃপক্ষ চিন্তায় পড়েছেন। লাইটার, আঠা বা ব্লেডের মতো নিষিদ্ধ জিনিস কী ভাবে বন্দিদের হাতে পৌঁছল, তা ভেবে ওঁরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে সেলের তালার চাবির মাপ পর্যন্ত দীপকেরা জোগাড় করে ফেলায় কর্তৃপক্ষ সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। প্রেসিডেন্সি জেলের সুপার দেবাশিস চক্রবর্তী সোমবার জানিয়েছেন, সজল মিত্র-সহ কয়েক জন কারারক্ষীকে তৎপরতার ইনাম দেওয়ার জন্য দফতরের কাছে তিনি সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি গাফিলতির দিকটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ‘‘পুলিশকে আমরা সব জানিয়েছি। পুলিশ বিস্তারিত তদন্ত করছে।’’— বলেন তিনি।
শামিম-দীপকদের ছক ভেস্তে যাওয়ায় কারা দফতর মস্ত বেইজ্জতি থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে মানছেন তাবড় কর্তারা। এক জনের কথায়, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে খবর ছিল, মাওবাদীরা জেল ভাঙতে পারে। দীপক-শামিম এ ভাবে পালিয়ে গেলে চরম লজ্জায় পড়তে হতো।’’ এ বার না হয় টর্চের আলো ওঁদের মুখ বাঁচিয়েছে। ‘‘বারবার ভাগ্য অতটা সহায় হবে কি?’’— প্রশ্ন উঠেছে কারা প্রশাসনেরই অন্দরে।