ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া কুণালকে টেনে সিবিআই দফতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
সাংবাদিকদের দেখে মুখ খুলতেই পিছন থেকে এক ধাক্কা। সিবিআই দফতরের সিঁড়িতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন কুণাল ঘোষ। সোমবার সেই অবস্থাতেই তাঁকে টেনে তুলে নিয়ে দফতরের ভিতরে চলে গেল পুলিশের একটা দল। যার নেতৃত্বে বিধাননগর দক্ষিণ থানার ওসি।
সিবিআই সূত্রের খবর, পড়ে গিয়ে কপালে, হাতে, কোমরে চোট পেয়েছেন কুণাল। পরে দফতরের ভিতরেই চিকিৎসক ডেকে তাঁর চিকিৎসা করানো হয়। সকালে এই বিষয়টি নিয়ে প্রথমে অভিযোগ করেন কুণালের আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা। তিনি বলেন, “আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ওঁর চোট লেগেছে।” বিকেলে সিবিআই দফতরের একতলা থেকে দোতলায় যাওয়ার পথে কুণাল বলেন, “সকালে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে। অহেতুক ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। আমার চোট লেগেছে, রক্ত বেরিয়েছে। পরে টেটভ্যাক নিয়েছি, ব্যথার ওষুধ খেয়েছি।” এ দিন রাত ৮টা ৫০ নাগাদ কুণালকে সিবিআই দফতর থেকে বের করা হয়। তখনও ছবিটা ছিল এক। কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যাতে তিনি কথা বলতে না পারেন, সে ব্যাপারে অত্যন্ত তৎপর ছিল পুলিশ।
সিবিআই হেফাজতে থাকা এক অভিযুক্তের প্রতি পুলিশের এই আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে। সিবিআই-কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। পুলিশ কুণালকে এ ভাবে নিগ্রহ করা নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর। তারা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে। সিবিআইয়ের মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদ বলেন, “কুণাল আমাদের হেফাজতে থাকলেও তার দেখভালের দায়িত্ব পুলিশের। তাই পুলিশকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন।” যদিও কুণালকে টেনে নিয়ে যাওয়া, ঠেলে ফেলে দেওয়া নিয়ে বিধাননগরের পুলিশ কর্তারা কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
সল্টলেকে সিবিআই দফতরে ঢোকার মুখে শনিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিলেন কুণাল। বলেছিলেন, সারদার সংবাদমাধ্যম থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সব থেকে বেশি সুবিধা যদি কেউ পেয়ে থাকেন, তবে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরে রবিবার সিবিআইয়ের দফতর থেকে বেরোনোর মুখে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও সারদা সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ করেন কুণাল।
প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, কুণাল মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী ও শাসক দলের তাবড় নেতার নাম প্রকাশ্যে বলাতেই বিব্রত হয়ে পড়ছেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা। তাই সিবিআই দফতরে ঢোকা-বেরোনোর সময় বা আদালতে যাতায়াতের পথে কুণাল যাতে মুখ খুলতে না পারেন, সে ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠেছেন পুলিশকর্তারা।
পুলিশ যে কুণালের মুখ খোলা আটকাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে, রবিবারই তার আঁচ মিলেছিল। রবিবার সকালে সিবিআই দফতরের সামনে ব্যারাকপুর পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। রাতে কুণালকে নিয়ে যাওয়ার সময় পাহারা দিতে পুলিশ আনা হয় বিধাননগরের দু’টি থানা থেকে। সিবিআই দফতর থেকে বেরোনোর মুখে কুণালকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতেই রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে তাঁকে গাড়িতে তুলে দেয় পুলিশ।
প্রশ্ন উঠেছে, রবিবার থেকে সিবিআই দফতরে পুলিশ মোতায়েন নিয়ে। বিধাননগর পুলিশের একাংশ বলেছিলেন, প্রভাবশালীদের জেরা করার ক্ষেত্রে গোলমাল হতে পারে, তা আঁচ করে সিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বাহিনী মোতায়েন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এ দিন সিবিআই কর্তারা দাবি করেছেন, বাহিনী মোতায়েন করার ব্যাপারে রাজ্য পুলিশকে তাঁরা কিছু জানাননি। সিবিআই মুখপাত্র কাঞ্চন প্রসাদও বলেন, “এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।” তা হলে পুলিশ কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাহিনী মোতায়েন করল? সিবিআই সূত্রের দাবি, সিজিও কমপ্লেক্সে আরও কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস রয়েছে। তারা বাহিনী মোতায়েন করার আর্জি জানাতে পারেন।
যদিও রবি ও সোমবার অন্য কোনও দফতরের বাইরে বাহিনী মোতায়েন থাকার দৃশ্য নজরে আসেনি। এ দিন সকালেই গাড়িতে চাপিয়ে কুণালকে নিয়ে আসা হয়। তখন থেকেই সিবিআইয়ের ডিআইজি (স্পেশ্যাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ) দফতরের বাইরে জনা কয়েক পুলিশকর্মী মোতায়েন ছিল। ওই অফিসেই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তকারীরা বসছেন। বেলা দু’টো নাগাদ বড় গাড়িতে চেপে আরও এক দল পুলিশ আসে। তাঁরাও ওই দফতরের বাইরেই ‘পজিশন’ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হওয়ার এত দিন পরে হঠাৎ এমন বাহিনী মোতায়েন কেন? এ প্রশ্নেও কোনও মন্তব্য করতে চাননি বিধাননগরের পুলিশকর্তারা।
পুলিশ সূত্রের খবর, কুণাল ও সারদা কেলেঙ্কারিতে বাকি অভিযুক্তরাও যাতে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে না পারেন, সে দিকেও চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্য প্রশাসন। আলিপুর ও ব্যাঙ্কশাল আদালতে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে লালবাজার সূত্রের খবর। এ দিনই আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়েছিল সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়কে। সাংবাদিকরা যাতে কোনও ভাবেই সারদা-কর্তার কাছে ঘেঁষতে না পারেন, তার জন্য কলকাতা ৫০ জন পুলিশকর্মীকে এ দিন মোতায়েন করা হয়েছিল আলিপুরে।
কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তারা এই বাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারে বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্তরা কেন্দ্রীয় সংস্থার অধীনে রয়েছেন। কিন্তু আদালতে যাতায়াতের পথে তাঁদের উপরে আক্রমণ হলে রাজ্য সরকারের দায়িত্ব। তাই এই অতিরিক্ত নিরাপত্তা। যদিও প্রশ্ন উঠেছে, মে মাসে সিবিআই তদন্ত শুরু হওয়ার পর সুদীপ্ত-কুণালকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। কিন্তু কুণাল মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে মন্তব্য করার আগে পর্যন্ত এমন নিরাপত্তা তো ছিল না! কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের পরিবর্তিত ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।”