Pranab Mukherjee

সেই প্রথম এত কাছ থেকে দেখেছিলাম প্রণববাবুকে, মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা

কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেই বেথুয়াডহরিহাসপাতালের চিকিৎসককে প্রণববাবু লিখেছিলেন, ‘প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ’।

Advertisement

সমর বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ২১:০১
Share:

২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল। দুর্ঘটনার সেই রাতে। ছবি: সংগৃহীত

কিছু ক্ষণ আগেই আভেনে ভাত বসিয়েছি। জলটা ফুটছে। আমি তখন একটি টিভি চ্যানেলের নদিয়া জেলা করেসপন্ডেন্ট। কৃষ্ণনগরের অফিসেই রাতে থাকার ব্যবস্থা ছিল। আমি এবং আমার সহকর্মী চিত্রসাংবাদিক এক দিন অন্তর পালা করে অফিসে থাকতাম। সে দিন ছিল আমার থাকার পালা। কিন্তু আমার সহকর্মীও সন্ধ্যার দিকে বললেন, আজ আর বাড়ি যাবে না। তাই সাড়ে আটটা নাগাদ ভাত বসিয়ে দু’জনেই অফিস রুমে বসে টিভি দেখতে দেখতে বসে কথাবার্তা বলছিলাম।

Advertisement

এমন সময় একটা ফোন এল। ফোনের ও-প্রান্ত থেকে এক জনের থতমত, কাঁপা কাঁপা গলা। বললেন, ‘‘দাদা, প্রণব মুুখোপাধ্যায়ের কনভয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রণববাবুকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। মাথায় সেলাই করছেন হাসপাতালের ডাক্তার। আমি ছবি তুলছি।’’

শোনামাত্র খবরটার গুরুত্ব ও ব্যাপকতা বুঝে নিজের কর্তব্য ঠিক করতেই কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। সেই প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে চিত্রসাংবাদিককে বললাম, ‘‘শিগগির বাইক বার কর। এক্ষুনি বেথুয়াডহরি যেতে হবে।’’ কোনওরকমে হাতের সামনে যা পেলাম তাই গায়ে চাপিয়ে উঠে পড়লাম বাইকের পিছনে। গ্যাস বন্ধ করে আমাকে পিছনে বসিয়ে বাইক ছোটাতে শুরু করলেন আমার সহকর্মী। বাইকে যেতে যেতেই কলকাতায় হেড অফিসে জানালাম। তৎকালীন নদিয়ার পুলিশ সুপার হরিকিশোর কুসুমাকারকে ফোন করলাম। জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনার সঙ্গেও কথা হল। সবাই ছুটেছেন বেথুয়াডহরির উদ্দেশে।

Advertisement

সেটা ২০০৭ সালের ৭ এপ্রিল। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন দেশের বিদেশমন্ত্রী। মুর্শিদাবাদে একটি কর্মসূচি সেরে কলকাতা ফিরছিলেন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে। সেই সময়ই উল্টো দিক থেকে আসা একটি লোহার রড বোঝাই লরির পিছনের ডান দিকের চাকা ফেটে প্রণববাবুর গাড়ির ডান দিকের কোনাকুনি ঘেঁষে মুখোমুখি ধাক্কা মারে। পিছনের গাড়িতেই ছিলেন প্রণববাবুর আপ্ত সহায়ক প্রদ্যোৎ গুহ। তিনি ছুটে গিয়ে দেখেন, প্রণববাবুর মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। প্রণববাবুর গাড়িতেই ছিলেন মানস ভুঁইয়া, তিনিও অল্প চোট পেয়েছেন। গাড়ির চালক গুরুতর জখম। কিন্তু পাইলট কার অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি আঁচ করে সেই গাড়িও ফিরে আসে দুর্ঘটনাস্থলে। সবাই মিলে ধরাধরি করে গাড়ি থেকে অচৈতন্য প্রণববাবুকে গাড়ি থেকে বার করেন। পাইলট কারে তুলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় কাছেই বেথুয়াডহরি গ্রামীণ হাসপাতালে।

আরও পড়ুন: প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়, রাইসিনা হিলে ওঠা একমাত্র বাঙালি

এই খুঁটিনাটি ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা অবশ্য শুনেছিলাম পরে। অন্য দিকে আমরা তখনও বেথুয়াডহরি পৌঁছতে পারিনি। বাহাদুরপুর ফরেস্ট পেরিয়ে ধুবুলিয়া ঢোকার মুখে। অফিসের টানা লাইভ ফোন-ইনের এক ফাঁকে নাকাশিপাড়া থানার তখনকার ওসি পিন্টু সাহার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, প্রণববাবুকে কৃষ্ণনগরে শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সেটা শুনে থেমে গেল আমাদের বাইক। আমরা দাঁড়িয়ে পড়ার পর দেখি পিছনেই আর একটা প্রেসের গাড়ি। আমাদের দেখে সেটাও দাঁড়াল। দেখলাম আনন্দবাজার আর টেলিগ্রাফের সাংবাদিক ওই গাড়িতে। তখন আমার চিত্র সাংবাদিককে বললাম বেথুয়া যেতে। আর ওই গাড়িতে ইউ টার্ন করে আমরা তিন জন রওনা দিলাম কৃষ্ণনগরের দিকে।

আরও পড়ুন: কীর্ণাহার থেকে রাইসিনা: চাণক্যের চড়াই-উৎ‌রাই যাত্রাপথ

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে রাত দিন বাস, লরি, ছোট গাড়ি চলার অন্ত থাকে না। আমরা খানিকটা এগিয়ে জলঙ্গি নদীর ব্রিজের উপর যখন পৌঁছলাম, তখন রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই হুটারের শব্দ। বুঝলাম প্রণববাবুর কনভয় কৃষ্ণনগরে আসছে। কাছে আসতে আমরাও ওই কনভয়ের পিছু নিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রণববাবুর কনভয় ঢুকে পড়ল শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। সেখানে পুলিশ প্রশাসন আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তাই আসার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে। সেই প্রথম অত কাছ থেকে দেখলাম প্রণববাবুকে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। প্রায় চোখের নিমেষে ঢুকিয়ে দেওয়া হল হাসাপাতালে।

হাসপাতালের চিকিৎসক ও অন্যান্য সূত্রে জানতে পারলাম, অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলেও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়েনি। বেথুয়াডহরি ব্লক হাসপাতালের তখনকার চিকিৎসক পলাশ মজুমদার যে সেলাই করেছিলেন, তাতে কোনও অসুবিধা নেই। তবে তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন: সংগ্রহ করতেন নিজের কার্টুন, রাষ্ট্রপতি ভবনে সে সবের প্রদর্শনীও করেন প্রণব

সারা রাত হাসপাতালেই ছিলাম। জেলার নেতা-নেত্রী-কর্মীদের ভিড় বাড়ছে হাসপাতালে। বহরমপুর থেকে চলে এসেছেন অধীর চৌধুরী। হাসপাতালের বাইরে চায়ের দোকানে বসেছেন তিনি। তাঁকে ঘিরেও জটলা। আমরা দু’জন হাসপাতালের চত্বরেই খাবার কিনে খেয়ে নিলাম। বেথুয়াডহরি হাসপাতালে আমাদের যে চিত্রসাংবাদিক ভিডিয়ো তুলেছিলেন, তিনিও কৃষ্ণনগরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন জানিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাত প্রায় একটা নাগাদ হঠাৎ একটা ধাবা থেকে ফোন করে তিনি জানালেন, বাইক বিগড়েছে। মোবাইলের ব্যাটারিও শেষ। তখন আমি আবার বাইক নিয়ে ছুটলাম তাঁকে আনতে। কারণ, প্রণববাবুর মাথায় সেলাই করার ওই গুরুত্বপূর্ণ ভিডিয়োটা ওঁর কাছেই ছিল। তাঁকে নিয়ে অফিসে পৌঁছলাম রাত দেড়টা নাগাদ। কলকাতার অফিসে ছবি পাঠিয়ে আবার ছুটলাম হাসপাতালে।

আরও পড়ুন: দেশের বিকাশে প্রণবের ভূমিকা স্মরণ মোদীর || পিতৃসম ছিলেন, বললেন মমতা

রাতটা ওই ভাবেই কখনও চায়ের দোকানে, কখনও হাসপাতালের বাইরের সিমেন্টের বেদিতে বসে কেটে গেল। মাঝে ছোট, বিচ্ছিন্ন বহু ঘটনাবলী। ভোরের আলো ফুটতেই কলকাতার সাংবাদিক মহল পৌঁছে গিয়েছিল শক্তিনগর হাসপাতালে। সকালে জানা গেল, কৃষ্ণনগর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে সীমানগর বিএসএফ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে প্রণববাবুকে। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে দিল্লিতে। কিন্তু বেথুয়ার ভিডিয়ো ছাড়া প্রণববাবুর তেমন ছবি আর পাওয়া যায়নি। তাই সুযোগ খুঁজছিলাম ভিডিয়ো তোলার। চিত্রসাংবাদিকও চেষ্টা করছিলেন, ক্যামেরা লুকিয়ে কোনও ভাবে যদি ভিতরে ঢোকা যায়। কিন্তু সবই বিফল। শেষে উপায় বার হল, তবে ক্যামেরা ছাড়া। তখনকার ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী (এখন তৃণমূল বিধায়ক) প্রণববাবুকে দেখতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে ঢুকে পড়লাম। একটি ঘরে দরজার বাইরে থেকে কাচের ফাঁক দিয়ে দেখলাম প্রণববাবু শুয়ে আছেন। পুরো মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো। ঘুমে আচ্ছন্ন।

হেলিকপ্টারের আয়োজন সারা হতে হতে দুপুর হয়ে গেল। সঠিক সময়টা মনে নেই। তবে দুপুর ১২টার কিছু পরে হবে— শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে ফের বেরোল প্রণববাবুর অ্যাম্বুল্যান্স-সহ কনভয়। আমরাও পিছন পিছন ছুটলাম বাইকে। সীমানগর বিএসএফ ক্যাম্প থেকে প্রণববাবুকে তুলে হেলিকপ্টার উড়ে গেল। দৃষ্টির অগোচরে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই। তার পর কৃষ্ণনগরের ফিরতি পথ ধরলাম।

আজ প্রণববাবুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সেই ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত ভেসে উঠছে স্মৃতিতে। কিন্তু দুর্ঘটনার পরের একটি ঘটনায় প্রণববাবু যে কত বড় মনের মানুষ ছিলেন, সেটা জানতে পেরেছিলাম। চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পরেই বেথুয়াডহরির মতো মফস্সলের গ্রামীণ হাসপাতালের সদ্য পাশ করা চিকিৎসককে দেশের তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement