Sourav Ganguly

পুজোর ‘সৌরভে’ রাজনীতির টক্করও

প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক এ দিন ঠিক অতিথি নন, আয়োজকদের একজন হয়ে উঠেই ইউনেস্কোর সামনে কলকাতা এবং কলকাতার পুজোর মহিমা তুলে ধরেছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:৪৩
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

মাস চারেক আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কেন্দ্রের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দুর্গাপুজোকে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি উদ্‌যাপনের সেই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে না-ডাকার অভিযোগে জলঘোলা হয়। ক’দিন আগে নয়াদিল্লির জাদুঘরে কেন্দ্রের আর একটি অনুষ্ঠানেও রাজ্যের উপস্থিতি কার্যত ছিলই না। বৃহস্পতিবার কলকাতায় রাজ্য সরকারের পদযাত্রা ও রেড রোডের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ধারে-ভারে কেন্দ্রকেই এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল। রেড রোডের মঞ্চে ইউনেস্কোর কর্তাদের সামনে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সর্বাধিনায়ক বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়রাও উপস্থিত ছিলেন। এই আবহে তিনি বলেন, ‘‘রেড রোডের বুকে বিশেষ ঐতিহাসিক (রিমার্কেবল, হিস্টরিক্যাল) অনুষ্ঠান হল। মনটাকে ভাল রাখুন, খুশি রাখুন, উন্মুক্ত রাখুন, হৃদয়টাকে খোলা রাখুন, বন্ধ করবেন না। বাংলা নতুন করে জাগুক, জাগাক সকলকে।’’ বিজয়ায় রাজ্যের ইতিহাস সৃষ্টি করা কার্নিভাল বা দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলায় স্বাধীনতা দিবসে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান হওয়ার দাবিও মুখ্যমন্ত্রী মেলে ধরেন।

Advertisement

টলিউডি চিত্রতারকা, ছৌ, বাউল শিল্পী, ময়দানের তিন প্রধান, পুজো কর্মকর্তা থেকে স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় লক্ষ লোকের সমাগমেও মুখ্যমন্ত্রী এক ধরনের বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এসেছিলেন বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়া মানুষজন। পুজোর ঠিক এক মাস আগে কার্যত এ দিন থেকে পুজো শুরু বলে ঘোষণাও করে দেন মমতা। রাজ্যের বিরোধীরা— সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস এক সুরেই বলেছে, পুজোর এক মাস আগে বিপুল খরচ করে এত জাঁকজমকের অনুষ্ঠান আসলে শাসক দলের বিভিন্ন দুর্নীতি থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা।

তা ছাড়া, দিনভর এই অনুষ্ঠানে অবশ্য যানজটে নাকাল হতে হল সাধারণ পথচলতি মানুষের একাংশকে। প্রশ্ন উঠল, এই অনুষ্ঠানের জন্য স্কুল থেকে পড়ুয়াদের টেনে আনা কেন? কেনই বা এ দিন কম সরকারি অফিসে হাজিরা? শুধু কলকাতা নয় জেলাতেও কলকাতার পুজোর ইউনেস্কো স্বীকৃতি নিয়ে মিছিল হয়েছে। মানুষ তাঁদেরই পাশে — দুর্নীতির অভিযোগের আবহে এই অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শাসক দল এই বার্তা দেওয়ারই চেষ্টা করেছে বলে রাজনীতির কলাকুশলীদের একাংশ মত প্রকাশ করছেন।

Advertisement

এই অনুষ্ঠানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থিতি। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক এ দিন ঠিক অতিথি নন, আয়োজকদের একজন হয়ে উঠেই ইউনেস্কোর সামনে কলকাতা এবং কলকাতার পুজোর মহিমা তুলে ধরেছেন। তাতে আপ্লুত মুখ্যমন্ত্রীও ‘সৌরভ আমার ছোট ভাই, ও খুব ভাল বলেছে’ বলে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এর আগে ভিক্টোরিয়ায় অমিত শাহের অনুষ্ঠানে সৌরভজায়া ডোনা গঙ্গোপাধ্যায় শিল্পী হিসেবে নৃত্যানুষ্ঠানে ছিলেন। পরে রাজ্য বিজেপি নেতাদের নিয়ে সৌরভের বাড়িতেই নৈশাহার সারতে যান অমিত শাহ। এ দিন বিজেপি-র আইটি সেল কর্তা অমিত মালবীয়ও কলকাতার দুর্গাপুজোর সব কৃতিত্ব কেন্দ্রের সঙ্গীত নাটক একাডেমির বলে টুইট করেন। মমতা অবশ্য তাঁর বক্তৃতায় কোনও বিতর্কে ঢোকেননি। মঞ্চে উপস্থিত ইতিহাসবিদ তথা দুর্গাপুজো গবেষক তপতী গুহঠাকুরতা (যিনি ইউনেস্কোর কাছে দুর্গাপুজো বিষয়ক প্রস্তাবটি তৈরি করেন) স্পষ্টই বলেন, ‘‘কারও একার কৃতিত্বে দুর্গাপুজো এ স্বীকৃতি পায়নি।’’

শোভাযাত্রা এ দিন বাহবা কুড়িয়েছে ইউনেস্কো কর্তাদের থেকেও। মোহনবাগানের পালতোলা নৌকো, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের কর্মকর্তাদের দেওয়া দুর্গামূর্তির স্মারক উপহার পান ইউনেস্কো কর্তারা। ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ কনভেনশনের সেক্রেটারি টিম কার্টিস বলেন, ‘‘এ হল একটি জলজ্যান্ত ঐতিহ্যের নিদর্শন। এত ধরনের লোকের উপস্থিতি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে, দুর্গাপুজোর বহতা ধারা আরও বহু প্রজন্মকে পুষ্ট করবে।’’ দুর্গাপুজোর স্বীকৃতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্র, রাজ্য সরকারের সব সংস্থা, পুরোহিত, ঢাকি, কারুশিল্পী সবাইকে তিনি অভিনন্দন জানান। দিল্লিতে ইউনেস্কোর প্রতিনিধি এরিক ফল্টও বলেছেন, ‘‘যা দেখলাম, অভাবনীয়! তিন মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী আমায় এই অনুষ্ঠানের কথা বলেন। সেটা যে এমন বর্ণাঢ্য ভাবতে পারিনি। আমরা প্যারিসে ইউনেস্কোর সদরে সব জানাব। ইউনেস্কোর ঐতিহ্য কনভেনশনের সদস্য দেশগুলিকেও বলব। কত রংবেরঙের মানুষ এই উৎসব পালনে এসেছে। এটাই কারণ দুর্গাপুজোর স্বীকৃতির। এই স্বীকৃতি নিয়ে এমন উন্মাদনা আমি আগে দেখিনি। আমরা আবার কলকাতায় প্রাক-পুজো উৎসবে ফিরে আসব। রাজ্য সরকারের সঙ্গে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উদযাপনে নানা রকম কাজের সম্ভাবনা রয়েছে।’’ ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-সি রানাপ্রতাপ কলিতাও এ দিনের অনুষ্ঠানে কলকাতার দুর্গাপুজোর মুক্ত কন্ঠে প্রশংসা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরদর্শিতার কথা বলেন।

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন দুর্গাপুজোকে ঘিরে সব ধরনের মানুষের উপার্জনের দিক তুলে ধরেন। রাজ্যের উদ্যোগে ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং খড়্গপুর আইআইটির সমীক্ষার ফলের কথা তুলে তিনি বলেন, ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় পুজোকে ঘিরে। গরিব, বড়লোক, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ছোট দোকান মালিক সবাই এর শরিক। আমি হিন্দু, মুসলিম, জৈন, খ্রিস্টান যা-ই হই, সবার উৎসব দুর্গাপুজো। এই মানবতা, ঐক্য আমাদের শক্তি।’’ ইউনেস্কোর কর্তাদের পুজো ও কার্নিভাল দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘এ পৃথিবী আসলে একটাই দেশ। এ মঞ্চ বিশ্ব মঞ্চ। আমি বলি ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। ধর্ম ব্যক্তিগত, কিন্তু উৎসবের উদ্‌যাপন সর্বজনীন। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আমাদের উৎসাহ জোগাবে।’’ এর পরে ইউনেস্কোকে বিনীত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা যেমন বলেছেন, তেমনই অনেকের মতে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুর বাঁধার চেষ্টাও এই বক্তব্যে স্পষ্ট। যে সম্প্রীতি ভঙ্গ করার অভিযোগে বিজেপির দিকে প্রায়শই আক্রমণ শানান তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement