Kamduni Case

কামদুনির পাশে আছি, বিরোধীরা একজোট, মন্ত্রী ফিরহাদের কটাক্ষ, এত দিন কোথায় ছিলেন?

২০১৩ সালের ৭ জুন কামদুনির কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। পর দিন থেকে গ্রামে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। সেই জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে কার্যত গোটা রাজ্যে।

Advertisement

ঋষি চক্রবর্তী

কামদুনি শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:০৭
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

দশ বছর আগে যে বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল কামদুনি, শুক্রবার হাই কোর্টের রায়ের পরে শনিবার সেই ছবিই ফিরে এল সেখানে। সঙ্গে যুক্ত হলেন প্রায় সব বিরোধী দলের নেতারা। একই সঙ্গে কামদুনিতে এ দিন ছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সিপিএম নেতা শতরূপ ঘোষ এবং কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী জেলায় একটি অনুষ্ঠান থাকায় কামদুনিতে আসতে পারেননি। তবে সুকান্তের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিবৃতিও দিয়েছেন। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দিল্লি থেকে চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছেন, তিনি যাতে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। নির্যাতিতার পরিবার তো বটেই, কামদুনি আন্দোলনের প্রধান মুখ টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়ালেরা এ দিন জানিয়ে দেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। তাঁরা আরও জানান, শুক্রবার রাতেই কামদুনিতে সিআইডি-র প্রতিনিধি দল এসে প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের উপরে পরিবারের বিশেষ ভরসা নেই। টুম্পা, মৌসুমীরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন দলের নেতাদের তাঁরা পতাকা সরিয়ে রেখে তাঁদের আন্দোলনে যোগ দিতে বলেন। এ দিন বিরোধী নেতাদের দলীয় পতাকা ছাড়াই সেখানে দেখা গেলেও ছিলেন না তৃণমূলের কেউ। উল্টে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এক প্রশ্নের জবাবে বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘যাঁরা আজ আন্দোলন করছেন, তাঁরা গত দশ বছর আন্দোলন করলেন না কেন? ন্যায় পেতে দেরি হচ্ছে বলে!’’

Advertisement

২০১৩ সালের ৭ জুন কামদুনির কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। পর দিন থেকে গ্রামে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ-প্রতিবাদ। সেই জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে কার্যত গোটা রাজ্যে। এ বারেও, শুক্রবার হাই কোর্টের রায়ের পরে ফের এককাট্টা হয়ে পথে নেমেছেন কামদুনির মানুষ। শনিবার বিকেল থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে রাজারহাট-খড়িবাড়ি রোডের কামদুনি মোড়ে অবরোধ চলে।

এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার রাতেই গ্রামে ঘুরে গিয়েছে সিআইডি। মৌসুমীর বাড়িতে যান অফিসারেরা। দেখা করেন নিহত তরুণীর বাবা-মায়ের সঙ্গেও। ছিল রাজারহাট থানার প্রচুর পুলিশ। সিআইডির তরফে আশ্বাস মিলেছে, ন্যায্য বিচার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবে রাজ্য সরকার। যদিও এই আশ্বাসবাণীতে নরম হননি গ্রামের মানুষ। নির্যাতিতার ভাই এ দিন বলেন, “সিআইডি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা বলছে। তবে আমাদের সিআইডি-তে ভরসা নেই, এ কথা প্রথম থেকেই বলেছি। আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে আলোচনা করব।” নির্যাতিতার মায়ের কথায়, “আমরা সুপ্রিম কোর্ট যাব। দিল্লির ঘটনায় (নির্ভয়া-কাণ্ড) ফাঁসি হল, অথচ, আমাদের বেলা কেন তেমন বিচার হবে না? ফাঁসি চাই। পুলিশ, সিআইডি তদন্ত, ডাক্তারি রিপোর্ট— কোনওটাই ভাল ভাবে দেওয়া হয়নি। সে জন্যই এমন বিচার হয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আগে যে বিচার হয়েছিল (নিম্ন আদালতে), আমরা তাতেই খুশি ছিলাম। রাজ্য সরকারের পায়ে ধরছি, পুরনো রায় বহাল থাকুক।” নির্যাতিতার বাবাও বলেন, “দিল্লি বিচার পেলে কামদুনি কেন পাবে না?”

Advertisement

সিআইডির তরফে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ইতিমধ্যে ডিআইজি স্তরের এক অফিসারের নেতৃত্বে বিশেষ দল তৈরি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে ‘স্পেশাল রিট পিটিশন’ দাখিল করতে চলেছে রাজ্য। পরিবারের সঙ্গে কথা বলেই সুপ্রিম কোর্টে যেতে চায় তারা।

এ দিন কামদুনির মানুষের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন সুকান্ত, শতরূপ ঘোষ, কৌস্তভ বাগচীরা। সিপিএমের মহিলা সংগঠনের নেত্রীরাও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর স্ত্রী রমলাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মৌসুমী, টুম্পারা। শতরূপ বলেন, ‘‘এই রায় মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশ-প্রশাসন ও রাজ্য সরকার অপদার্থ। তারা এখন বলছে সুপ্রিম কোর্টে যাবে। এখানে যে রিপোর্টের ভিত্তিতে আদালত রায় দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টে গেলে কি তার উল্টো হবে? রাজ্য সরকার কেন টাকা দিয়ে আইনজীবী নিয়োগ করেনি?’’

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরী আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি পাঠান এ দিন। সেখানে লেখেন, ‘‘বিচারব্যবস্থার উপরে আমাদের সকলের আস্থা রয়েছে। তবে কামদুনি গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার রায় শুনে আমি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। এক জন সাংসদ হিসাবে এই ঘটনার রায় নিয়ে কোনও বিতর্কিত মন্তব্য করা আমার উচিত নয়। নিম্ন আদালত এর আগে এই মামলায় ফাঁসির সাজা শুনিয়েছিল। তবে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ফাঁসির সাজা রদ করেছে।’’ রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডি তদন্তে গাফিলতি ছিল বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন অধীর। রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডি সঠিক তথ্য জোগাড় করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, ‘‘এ কারণেই কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় দিয়েছে।’’ রেল প্রতিমন্ত্রী থাকাকলীন অধীর কামদুনির লোকজনকে দিল্লি নিয়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করাতে। ওই পরিবারকে যাতে দেখা করার সময় দেওয়া হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে সেই আর্জি জানিয়েছেন তিনি। কৌস্তভের কথায়, ‘‘তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের জন্য সরকার ও দল কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে দেশের সেরা আইনজীবীদের দিয়ে মামলা লড়ায়। কামদুনির নির্যাতিতার জন্য রাজ্য সরকার কেন আইনজীবী নিয়োগে উদ্যোগী হয়নি?’’

সুকান্ত বলেন, ‘‘এই বাংলায় ধর্ষণ খুন, রাহাজানি ছাড়া কিছু নেই। এখানে আসার আগে সুষমা স্বরাজের মেয়ে, আইনজীবী বাঁশুরী স্বরাজের সঙ্গেও কথা হয়েছে।’’ সুকান্ত বলেন, ‘‘নির্ভয়া-কাণ্ডে সকলের প্রায় সাজা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজকে আমরা লজ্জায় পড়ে গেলাম। বাংলা‌ দিল্লির কাছে হেরে গেল।’’ গভীর রাতে সিআইডির গ্রামে যাওয়ার ঘটনাকে কটাক্ষ করে সুকান্ত বলেন, ‘‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে!’’ পূর্ব মেদিনীপুরের মেচেদায় শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রাজ্য সরকারের সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এটা লোক দেখানো। রাজ্য সরকারের কৌঁসুলি এবং সিআইডি ঠিকঠাক ভূমিকা পালন করতে পারলে এ জিনিস হত না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে বাদীরাই যাবে। আমার সঙ্গে মৌসুমী কয়ালদের কথা হয়েছে। তাঁদের পূর্ণ সাহায্য করব। অভিজ্ঞ আইনজীবীদের নিযুক্ত করব।’’ শুভেন্দুর দাবি, এ দিন অরাজনৈতিক সভায় কামদুনির মানুষ তাঁকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। অন্য কাজ থাকায় যেতে পারেননি। শুভেন্দুর আশ্বাস, ‘‘নির্যাতিতার পরিবারের নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করব।’’

বিরোধীদের এই একজোট হয়ে সমালোচনার মুখে কলকাতার মেয়র তথা তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম শনিবার পুরভবনে এক প্রশ্নের জবাবে পাল্টা বলেন, ‘‘যাঁরা এখন হাই কোর্টের রায়ে বিরোধিতা করছেন, তাঁরা কি অশিক্ষিত? কামদুনির ঘটনার পরে পুলিশ যথাযথ তথ্যপ্রমাণ দিয়েছিল বলেই তো নিম্ন আদালতের বিচারক তিন জনকে ফাঁসির সাজা দিয়েছিলেন।’’ ফিরহাদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এক এক জন বিচারপতি নিজেদের রায় দিয়ে থাকেন। যে জন্য নিম্ন আদালত কঠোর সাজা দিলেও হাই কোর্টের বিচারপতি সাজা লঘু করেছেন।’’ তাঁর দাবি, ‘‘কামদুনির ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী ভুক্তভোগীদের পাশে থেকেছেন।’’ বিজেপিকে পাল্টা দুষে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিলকিস বানোকে যারা ধর্ষণ করেছিল, তাদের মালা পরানো হয়েছিল। কোনও সমাজবিরোধীকে আমরা মালা পরাই না। যাঁরা আজ আন্দোলন করছেন, তাঁরা গত দশ বছর আন্দোলন করলেন না কেন? ন্যায় পেতে দেরি হচ্ছে বলে!’’ আদালতের রায়ে মুক্ত অভিযুক্তেরা এখনও গ্রামে ফেরেনি। গ্রামবাসীদের একাংশের মতে, তারা এলাকায় ফিরলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। গৌতম ঘোষ নামে এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘আদালত রেহাই দিলেও মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছেন।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement