সাংবাদিকদের মুখোমুখি এনএসজি-র ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরী। শুক্রবার কলকাতায়।—নিজস্ব চিত্র।
খাতায়-কলমে তারা আইনরক্ষক। আমজনতার নিরাপত্তা দেখাই তাদের কাজ। কিন্তু ইদানীং পথেঘাটে, বিক্ষোভের ময়দানে তো বটেই, নিজেদের কর্মস্থল থানাতেও মার খাচ্ছে পুলিশ। কেন? ভয়ে-ভক্তিতে যারা এত দিন সমীহ আদায় করে এসেছে, সেই পুলিশ এখন জনতার বিদ্বেষের লক্ষ্য। কেন?
পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের যে-বিশ্বাস থাকার কথা, সেটাই হারিয়ে যাচ্ছে যে! আক্ষেপ করছেন ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড বা এনএসজি-র ডিজি জয়ন্তনারায়ণ চৌধুরী। পুলিশের উপরে মানুষের বিশ্বাস কেন হারিয়ে যাচ্ছে, তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষের রোজকার ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করার কথা পুলিশের। অথচ সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না পুলিশ। তাই পুলিশের প্রতি আমজনতার আস্থাটাই পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার মুখে।
এই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার উপরে জোর দিয়েছেন জয়ন্তবাবু। তিনি মনে করেন, মাওবাদী থেকে জঙ্গি যাদের নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত, যাদের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে, তাদের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে যাবে যদি পুলিশের উপরে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস বাড়ে। “তাতে সমাজের উপরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। দেখা যাচ্ছে, দেশের যে-সব অঞ্চলে গরিবেরা আইনের শাসন থেকে বঞ্চিত, জঙ্গি কার্যকলাপ বেশি মাথাচাড়া দিয়েছে সেখানেই। পুলিশ ঠিকঠাক কাজ করলে সেই সমস্যা কমবে,” আশা প্রকাশ করেছেন জয়ন্তবাবু।
শুক্রবার কলকাতায় বণিকসভার এক অনুষ্ঠানে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই পুলিশের দুর্দশার কথা তোলেন এনএসজি-র ডিজি। তিনি জানান, অসমের ডিজি থাকাকালীন রাত সাড়ে ৩টেয় তাঁকে ফোন করে এক মহিলা গাড়ি চুরি যাওয়ার অভিযোগ জানান। যার অর্থ, নিচু তলার পুলিশের উপরে বিশ্বাসই ছিল না সেই মহিলার। রাত দেড়টায় এক জন ফোন করে জানান, এটিএমে তাঁর কার্ড আটকে গিয়েছে, কী করবেন তিনি। এই দু’টি দৃষ্টান্ত দিয়ে জয়ন্তবাবু বলেন, “এই ধরনের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে আরও মনোযোগী হতে হবে পুলিশকে। মানুষের বন্ধু হতে হবে।”
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, পুলিশের প্রতি মানুষের বিশ্বাস শুধু যে তলানিতে ঠেকেছে, তা-ই নয়। প্রকাশ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভও উগরে দিচ্ছেন মানুষ। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে রাস্তায় নেমে হেনস্থা হয়েছেন পুলিশের কর্মী-অফিসারেরা। বোলপুর, পাড়ুই, শিলিগুড়ির মতো জেলার বিভিন্ন জায়গায় শুধু নয়, পুলিশ-নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে খাস কলকাতার বন্ডেল রোড, গিরিশ পার্ক, বড়বাজার, এমনকী আলিপুর থানার ভিতরেও। অসহায়ের মতো মার খেয়ে মুখ নিচু করে ফিরে আসছে পুলিশ। এই ধরনের যে-সব ঘটনায় বিরোধীরা জড়িত, সেখানে তৎপর হয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে হামলাকারীদের। যেখানে শাসক দলের লোক জড়িত, সেখানে মুখ বুজে সব হজম করতে হয়েছে পুলিশের নিচু তলার কর্মীদের।
কী বলছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তারা?
পুলিশকে ঠিকঠাক কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না বলে প্রাক্তন কর্তাদের অনেকের অভিযোগ। যেমন কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, পুলিশকে নিজেদের মতো কাজ করতে দিলে এক মাসের মধ্যে এই বাহিনী ঘুরে দাঁড়াবে। “কিন্তু এই মুহূর্তে পুলিশকে দেখে মনে হচ্ছে, তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। তারা যেন ঠিকই করে নিয়েছে যে, কাজ করবে না। ফলে মানুষের বিশ্বাস ফিরে আসার তো কোনও কারণই নেই,” প্রসূনবাবুর গলায় হতাশা।
হরেক কাজে পুলিশকে ব্যবহার করায় সমস্যা হচ্ছে বলে মনে করেন প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার সুজয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন পরীক্ষার সময় ত্রিসীমানায় পুলিশ দেখা যেত না। এখন শ্মশান থেকে শুরু করে শিক্ষা, যত্রতত্র ব্যবহার করা হচ্ছে পুলিশকে। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে পুলিশকে কাজে লাগালে এমনই তো হওয়ার কথা।” তাঁর বক্তব্য, জয়ন্তবাবু যদি বলতেন যে, পুলিশের কাজ করাটাই আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে, হয়তো সেটা আরও ঠিক হতো।
তাঁদের আমলে সব সময়েই সাধারণ মানুষ থানায় ঢুকে অনায়াসে অভিযোগ জানাতে পারতেন এবং জানালে পুলিশ অফিসারেরা সেই অভিযোগ খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখতেন, এমন দাবি করছেন না প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার। তবে তাঁর বক্তব্য, এখন পুলিশের পদক্ষেপের সঙ্গে এমন কিছু বিষয় জুড়ে যাচ্ছে, যার জেরে পুলিশের উপরে মানুষের আস্থা চলে যাচ্ছে। আলিপুরে থানায় পুলিশের উপরে হামলার কথা তুলে তিনি বলেন, “ওই ঘটনার পরে যে-ক’জনকে গ্রেফতার করা হল, তাঁদের পরে আদালত থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, তাঁরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এই খবর পড়ার পরে সাধারণ মানুষ কী করে পুলিশের উপরে বিশ্বাস রাখবে!”