ছত্রধরের শাস্তি

বন্‌ধ ঠেকাতে পুলিশের প্রচার, ধন্দে জঙ্গলমহল

বন্‌ধ সফল হবে কি না, জনগণ সাড়া দেবে কি না, সে সব পরের কথা। এমনও নয় যে, গত তিন বছরে মাওবাদীরা টুকটাক বন্‌ধ ডাকেনি। কিন্তু ছত্রধর মাহাতোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে আজ, সোমবার মাওবাদী ও পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটির ডাকা বারো ঘণ্টার জঙ্গলমহল বন্‌ধ ঘিরে পুলিশ ও আধা ফৌজ রীতিমতো তটস্থ।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৪:২৩
Share:

বন্‌ধ সফল হবে কি না, জনগণ সাড়া দেবে কি না, সে সব পরের কথা। এমনও নয় যে, গত তিন বছরে মাওবাদীরা টুকটাক বন্‌ধ ডাকেনি। কিন্তু ছত্রধর মাহাতোর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের প্রতিবাদে আজ, সোমবার মাওবাদী ও পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটির ডাকা বারো ঘণ্টার জঙ্গলমহল বন্‌ধ ঘিরে পুলিশ ও আধা ফৌজ রীতিমতো তটস্থ।

Advertisement

বেশ ক’বছর বাদে মাওবাদীদের বন্‌ধ ঠেকাতে নিরাপত্তাবাহিনীর এই তৎপরতা বাসিন্দাদেরও আশ্চর্য ঠেকছে। বস্তুত বন্‌ধ ব্যর্থ করতে পুলিশ-সিআরপি উঠে-পড়ে লেগেছে।পুরোদস্তুর পথ-প্রচার চালিয়ে মানুষকে ‘সুরক্ষার আশ্বাস’ দেওয়া হচ্ছে।এলাকার অনেকের মত, জঙ্গলমহলে পুলিশের এমন তৎপরতা দেখানোর দরকার গত তিন বছরে পড়েনি।

২০০৮-এ লালগড়ে মাওবাদীদের তত্ত্বাবধানে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাদেরই গড়া কমিটিকে সামনে রেখে। ছত্রধর ছিলেন কমিটির শীর্ষ নেতা। ২০১১ থেকে কমিটি ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে, শেষমেশ তার নাম-ই শোনা যেত না। ছত্রধরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে ডাকা এই বন্‌ধের মাধ্যমেই ফের কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে উঠে এল লালগড়ের দলিলপুর চকে তৈরি হওয়া জনগণের কমিটির নাম।

Advertisement

এ দিকে সিআরপি-র গোয়েন্দারা খবর পেয়েছেন, রবিবার লালগড়ের ১৫ কিলোমিটার দূরে বীরভানপুর-কলাইমুড়ি-মধুপুরের জঙ্গলপথে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র কাঁধে সাত-আট জনের একটি মাওবাদী স্কোয়াড দেখা গিয়েছে। মোটরবাইকে সওয়ার বাঁধগড়ার এক কাঠ-ব্যবসায়ী দলটির সামনে পড়েছিলেন। রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তারা জানিয়েছেন, ঝাড়খণ্ড-ছত্তীসগঢ় থেকে জঙ্গলমহলে ক’জন মাওবাদীর ঢুকে পড়ার খবরও রয়েছে। আশঙ্কা, লালগড়ে নাশকতা ঘটানোর উদ্দেশ্যেই তারা ঢুকেছে।

পরিণামে শনিবার রাত থেকেই যৌথবাহিনীর টহল বেড়ে গিয়েছে বহু গুণ। গাড়িতে চড়ে তো বটেই, পায়ে হেঁটেও টহল দিচ্ছে সিআরপি-পুলিশ।

মাওবাদীদের বন্‌ধে শেষ বার জঙ্গলমহলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছিল ২০১১-র ২৭ নভেম্বর। যার তিন দিন আগে, ২৪ নভেম্বর মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির মৃত্যু হয়। তাঁকে ভুয়োসংঘর্ষে হত্যা করা হয়েছে— এই অভিযোগ তুলে মাওবাদীরা বন্‌ধ ডেকেছিল। সেই থেকে ফি বছর কিষেণজির মৃত্যুদিনে মাওবাদীরা নাম-কা-ওয়াস্তে বন্‌ধ ডাকলেও এবং সাত দিন ‘শহিদ সপ্তাহ’ পালন করলেও প্রভাব তেমন পড়েনি। যৌথবাহিনী হুঁশিয়ার থেকেছে, এই যা।

কিন্তু এ বার ছবিটা পাল্টেছে। লালগড়ে পুলিশ মাইকে প্রচার চালিয়ে আহ্বান জানিয়েছে, ভয় না-পেয়ে জনজীবন স্বাভাবিক রাখুন, প্রশাসন পাশে আছে। জনগণের কমিটির প্রাক্তন এক নেতার কথায়, ‘‘তিন-চার বছর মাওবাদীদের বন্‌ধ নিয়ে পুলিশের এমন মাথাব্যথা তো দেখিনি! তার মানে কি পুলিশ ধরে নিয়েছে যে, বন্‌ধে প্রভাব পড়বে!’’ লালগড়ের এক মিষ্টির দোকানের মালিক রবিবার বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে, কাল দোকান বন্ধই রাখতে হবে।’’

গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: তৃণমূলে নাম লেখানো বহু যুবকও ছত্রধরের শাস্তি মেনে নিতে পারছেন না। কারণ তাঁরা মনে করেন, ছত্রধর সেই সময়ে মূলত গণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতেন। অথচ বহু নাশকতা, এমনকী খুনের অভিযোগও আছে যাঁর বিরুদ্ধে, কমিটির আর এক নেতা সেই সন্তোষ পাত্র দিব্যি দ্বারিগেড়িয়া গ্রামে নিজের বাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন! পুলিশের খাতায় যদিও তিনি ‘ফেরার।’

ফলত এই অংশের মনে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। আবার কিছু অঞ্চলে পঞ্চায়েতের কাজে দুর্নীতির প্রতিকার না-পেয়েও যুবকদের একাংশের ‘মোহভঙ্গ’ হয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দাদের কেউ কেউ। এক আইবি-অফিসারের কথায়, ‘‘ওঁদের কয়েক জন সম্প্রতি মাওবাদীদের সঙ্গে ফেরযোগাযোগ করেছেন। কেরল হাইকোর্টের রায়ও ওঁদের উৎসাহিত করেছে।’’ প্রসঙ্গত কেরল হাইকোর্ট বলেছে, মাওবাদী-চিন্তাধারায় বিশ্বাস করলেই কারও বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।

‘‘জমি তৈরিই হচ্ছিল। এ বার ছত্রধরের শাস্তিকে সামনে রেখে বন্‌ধ ডেকে মাওবাদীরা যাচাই করতে চাইছে, জঙ্গলমহলে সমর্থনের ভিত কতটা মজবুত।’’— মন্তব্য আইবি অফিসারটির।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement