—প্রতীকী ছবি।
চশমার পুরু লেন্স রুমালে মোছার ফাঁকে আক্ষেপে মাথা নাড়েন বৃদ্ধ। বলেন, ‘‘একটিই ছেলে। কিন্তু চাকরির জন্য সে-ও ভিন্ রাজ্যে। করবেই বা কী? এখানে কাজ কই?’’
বাম জমানার চৌত্রিশ বছর এবং তার পরে তৃণমূল শাসনের এক দশক পেরিয়েও এই দীর্ঘশ্বাস পিছু ছাড়েনি বাংলার। এ নিয়ে তর্ক হলেই শিল্পে লগ্নির অভাবকে কাঠগড়ায় তোলেন আমবাঙালি। বিশেষত বড় শিল্পে। কিন্তু আশ্চর্য হল, এ বারের মতো জোর টক্করের নির্বাচনেও শিল্পে লগ্নি টানা নিয়ে এখনও পর্যন্ত তেমন কথাটি নেই কোনও পক্ষের!
তিতিবিরক্ত জনতার মতে, জঙ্গি আন্দোলনে বহু কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার ‘কলঙ্ক’ বামেদের গা থেকে এখনও যায়নি। গত দশ বছরে বড় শিল্পে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আনার দাবি কখনও তেমন বুক ঠুকে করেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর যারা এ বার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, কেন্দ্রে সেই বিজেপির সরকারের ছ’বছরে দেশে নতুন কল-কারখানা কিংবা কাজের সুযোগ তৈরির ছবি তথৈবচ। তাই সিঙ্গুর নিয়ে ইতিউতি রাজনৈতিক-খোঁচা কিংবা ডেউচা-পাচামির মতো বড় প্রকল্পে বিপুল কর্মসংস্থানের দাবি ছাড়া শিল্প প্রসঙ্গে কথা বেশ কমই।
২০১১ সালে পরিবর্তনের ঝড় তুলে মমতার ক্ষমতায় আসার ভিত্তি ছিল জমি-আন্দোলন। তাই জোর করে জমি অধিগ্রহণের পথে না-হাঁটার কথা প্রথম দিন থেকে স্পষ্ট করেছেন তিনি। তা সে যতই তাঁকে বিরোধীরা সিঙ্গুর-খোঁচা দিন না কেন। অথচ এ রাজ্যে জমির মালিকানা বহু খণ্ডিত। তাই বড় প্রকল্পে যে পরিমাণ জমি লাগবে, তা জোগাড় করা কঠিন। অনেকের মতে, এ রাজ্যে বড় বিনিয়োগের পথে প্রথম বাধা রাজ্যের জমি-জটই।
আর্থিক সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগম থেকে ২০১১ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯৪টি সংস্থাকে ১,৮৫৫.৫ একর জমি দেওয়া হয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গ শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগমের থেকে দশ বছরে ৪৮৯টি সংস্থা পেয়েছে ১,৬২৩ একর। অর্থাৎ, ৫৮৩টি সংস্থার নেওয়া গড় জমি ৫.৯ একর। শিল্পমহলের মতে, এতে বড় প্রকল্প হয় না। শিল্প দফতরের অবশ্য দাবি, বিভিন্ন শিল্প পার্কে ৪.১৮ লক্ষ বর্গ ফুট জায়গা দেওয়া হয়েছে ৬৫টি সংস্থাকে। কিন্তু শেষমেশ ক’টি সংস্থা মোট কত লগ্নি করেছে, তা জানা শক্ত। রাজ্যের অবশ্য দাবি, গত ন’বছরে শুধু প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগই এসেছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার।
আর এক সমস্যা লাল ফিতের ফাঁস। রাজ্য সরকার ‘এক জানলা’ নীতির আশ্বাস দিয়েছে। চেষ্টা হয়েছে রাজ্যে বিনিয়োগ ও ব্যবসার পথ সহজ করার। দেশে এই সংক্রান্ত ক্রম-তালিকায় অনেক রাজ্যকে পিছনেও ফেলে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু শিল্পমহলে কান পাতলে শোনা যায়, এখনও ছাড়পত্র আদায়ে কী ভাবে এক দফতর থেকে আর এক দফতরে দৌড়তে হয় সংস্থার কর্তাদের।
সঙ্গে দোসর আবার তোলাবাজির অভিযোগ। শিল্পপতিরা একান্তে স্বীকার করেন, লগ্নির ছাড়পত্র পেতে ‘দক্ষিণার’ রেওয়াজ দেশের সর্বত্র। কিন্তু এ রাজ্যে বাড়তি সমস্যা হল, ‘কোথায় টাকা দিলে কাজ মসৃণ হবে, তা-ও নিশ্চিত নয়!’
শিল্প সম্মেলনের মঞ্চে প্রতি বার কয়েক লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি-প্রস্তাব এলেও, শেষ পর্যন্ত কল-কারখানা সেই অনুপাতে হয়নি (বিস্তারিত সঙ্গের সারণিতে)। রয়েছে শিল্পের জন্য উৎসাহ প্রকল্প না-থাকার ক্ষোভ। অথচ অনেকের প্রশ্ন, বড় শিল্প না-এলে, অনুসারী শিল্প হবে কী করে? ভাবমূর্তি বদলের জন্য অন্তত একটি নামী সংস্থার বড় বিনিয়োগ জরুরি বলেও মত অনেকের।
রাজ্যের দাবি, অশোকনগরে তেল প্রকল্পে অনেকে কাজ পাবেন। বিপুল কর্মসংস্থান হবে ডেউচা-পাচামিতে। বলা হচ্ছে কয়েকটি ইস্পাত ও সিমেন্ট সংস্থা, অ্যামাজ়ন, ফ্লিপকার্ট ইত্যাদির লগ্নির কথা। যে ছোট-মাঝারি শিল্পে জোর দেওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তার ছবি তুলনায় ভাল। কেন্দ্রের ২০১৫-১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যে নথিভুক্ত ছোট-মাঝারি শিল্পের সংখ্যা ৮৮.৩ লক্ষ। কর্মী ৪৩.৫১ লক্ষ। কিন্তু বিরোধীদের দাবি, এই ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লগ্নি এলেও, পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে লকডাউনের সময়ে এত জনকে বাংলায় ফিরতে হত না।
রাজ্যের গর্বের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে নতুন পালক রাজারহাটের সিলিকন ভ্যালি। দাবি, ইনফোসিসের ক্যাম্পাসের কাজ জুনে শুরু হবে। উইপ্রোর ৫০০ কোটি টাকার সম্প্রসারণে চাকরি হবে আরও ১০ হাজার জনের। এই শিল্পে এক দশকে কর্মসংস্থান ১৩৩% বেড়েছে বলে রাজ্যের দাবি। সঙ্গে বলা হচ্ছে, আইটি পার্ক, হার্ডওয়্যার পার্ক, ব্রডব্যান্ড নীতি, আন্তর্জাতিক মানের কনভেনশন সেন্টারের কথা। কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, তা হলে কী করে কলকাতাকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, এমনকি পুণে, ইনদওরের মতো শহর?
তা হলে শিল্প নিয়ে বিরোধীরা সে ভাবে সরব নন কেন?
উপদেষ্টা সংস্থা সিএমআইই-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারিতে রাজ্যে বেকারত্বের হার ৫.২%। দেশে ৬.৫%। ডিসেম্বরেও তা যথাক্রমে ৬% ও ৯.১%। সারা দেশে লগ্নির খরাও দীর্ঘ দিন ধরে। ফলে কথা তুলবে কে?