ছোট সিমেন্টের খুঁটিতে (চিহ্নিত) ভাগ দুই গ্রাম। হিলি সীমান্তের হাড়িপুকুরে। ছবি: অমিত মোহান্ত
‘‘কোনও তফাত নেই’’, বলছিলেন ওঁরা। কারও নাম বিমল সরকার, কারও নাম রবিউল ইসলাম। কেউ ভারতের বাসিন্দা, কেউ বাংলাদেশের। ঘড়িতে তখন দুপুর প্রায় বারোটা। একসঙ্গে বসে তাঁরা আলোচনা করছিলেন অযোধ্যা মামলার এ দিনের রায় নিয়ে।
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের সঙ্গে এ দিনের কী ফারাক দেখছেন— প্রশ্ন শুনে একযোগে বললেন তাঁরা, ‘‘কিছুই না। সে দিনও একসঙ্গে ছিলাম, আজও রয়েছি।’’
কিন্তু দুই দেশের দুই গ্রাম একসঙ্গে থাকে কী করে? ওঁরাই এগিয়ে নিয়ে গেলে গ্রামের গলি পথ ধরে। দেখালেন, এক দিকের দেওয়ালে এখনও আঁকা বিজেপি আর তৃণমূলের প্রচার চিত্র। ছ’মাসে ফিকে হয়ে এসেছে, কিন্তু মুছে যায়নি। ৫-৬ ফুট গলির অন্য দিকে মসজিদে ঢোকার দরজা। ঠিক এখানেই ওঁরা বললেন, ‘‘মাটিতে দেখুন।’’ চোখ নামাতেই দেখা গেল ফুটখানেক উঁচু একটি সিমেন্টের পরিচিত পিলার। সে দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘‘ওটাই দু’দেশের সীমানা-খুঁটি!’’
হিলিতে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের বেড়া। আন্তর্জাতিক নিয়মে বেড়ার ও-পার অর্থাৎ বাংলাদেশের গ্রামের সঙ্গে অবস্থান ভারতীয় ভূখণ্ড হাড়িপুকুরের। সীমান্তের কাঁটাতারের গেট থেকে প্রায় দেড়শো মিটার দূরে একটি ৫ ফুট চওড়া সিমেন্ট কংক্রিটের রাস্তা ঢুকে গিয়েছে হাড়িপুকুর গ্রামে। সেখানে হিন্দু-মুসলিম মিলে ৪০টি পরিবার একসঙ্গে বাস করে।
গ্রামের লোকেরাই জানালেন, বাংলাদেশের দিকে গ্রামটির নাম বাগমারা, ভারতের দিকে গ্রামটি হাড়িপুকুর।
দুই গ্রামের বসতি আর ধানের জমির মাঝে যে মেঠো পথ, তাতে হাঁটতে শুরু করলেও এই ফুটখানেক উঁচু সিমেন্টের খুঁটিগুলি চোখে পড়ে। ৪০-৫০ গজ দূরে দূরে বসানো। এই খুঁটিগুলিই চোখে দেখতে না পাওয়া দাগে টেনে দিয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
‘‘তাতে কী হয়েছে, আমরা বরাবরই একসঙ্গে থাকি,’’ বলেন বিমল। তাঁকে সায় দিয়ে রবিউল বলেন, ‘‘স্বাধীনতার সময় থেকেই দুই গ্রাম শান্তিতে রয়েছে, শুনেছি আমাদের বাপ-ঠাকুরদার মুখ থেকে।’’ সীমান্ত এলাকা, তাই বিএসএফের সতর্কতা চোখ এড়ায় না। সে সবে বেশি নজর না দিয়ে ওঁরা বলতে থাকেন, ‘‘কতবার জানেন, ওদিকের মসজিদের ইট জোগান দিয়েছে এদিকের হিন্দুরা। আবার এদিকের কালীমন্দির রক্ষণাবেক্ষণে এগিয়ে এসেছেন ওদিকের মুসলমানেরা।’’
বিমল বলেন, ‘‘এদিকের মুসলমানেরা কিন্তু ওদিকের মসজিদে নমাজ পড়তে যায়। তাতে শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটে না।’’ যেমন ঘটেনি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, বারবি মসজিদ ভাঙার দিন। তেমনই এদিনও দুই গ্রামের কাছে আরও একটা সাধারণ দিনের মতো।
গল্প শুনতে শুনতে বেলা বয়ে যাচ্ছিল। কথা শেষ করে ফিরে আসার সময় পিছনে তাকাতে দেখা গেল, বিমলের পিঠে হাত রেখে হাসতে হাসতে কিছু বলছেন রবিউল।