অন্যদের সঙ্গে মিছিলে মহম্মদ আফরোজ (মাঝে)। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
জোড়াসাঁকোর প্রবেশপথের সামনে বাঁধা অস্থায়ী মঞ্চে তখন বক্তৃতা করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামনের ভিড় ঠেলে সে দিকে এগোনোর চেষ্টা করেও পারলেন না মহম্মদ আফরোজ। সহকর্মী রাজকুমার ঘোষের সঙ্গে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই চেষ্টা করছিলেন ‘দিদি’কে একটি বার দেখার।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য কানে আসতেই আফরোজ ও রাজকুমার বলে উঠলেন, ‘‘দিদি ঠিকই বলেছেন। এ দেশ আমাদের সবার। কে ভাগ করবে আমাদের!’’
রাজকুমার আদতে বিহারের সহরসা জেলার বাসিন্দা। আফরোজ দ্বারভাঙার। দু’জনেই ৩০ বছর ধরে মেছুয়া বাজারে মোটবাহকের কাজ করছেন। আগে কখনও রাজনীতি না করলেও সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিছিলে পা মেলালেন দু’জনেই। কারণ তাঁরা মনে করেন, নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় সকলকেই একজোট হতে হবে। ‘‘আজ অসম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ জ্বলছে। কাল হয়তো বিহার জ্বলবে। তাই আগে থেকেই মিছিলে হাঁটলাম, অসুবিধা কোথায়?’’ প্রশ্ন আফরোজের।
একই মত মেছুয়া বাজারের আরও অনেকের। যাঁরা আগে কোনও দিনও রাজনৈতিক মিছিলে পা মেলাননি, এ দিন তাঁরাও হাঁটলেন নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায়। মেছুয়া বাজারের ওই কর্মীরা জানান, এশিয়ার বৃহত্তম এই ফলের বাজারে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী আছেন। কারও বাড়ি বিহারে, কারও বা উত্তরপ্রদেশে। কাজের সূত্রে যাঁরা বংশ পরম্পরায় এ রাজ্যে আছেন। তাই তাঁরা সকলেই এক বাক্যে বলতে চান, ‘‘এ দেশের মাটি আমাদের সকলের। এখানে কেউ হিন্দু নয়, কেউ মুসলিম নয়। কে কোন রাজ্যের, সেটাও বড় কথা নয়।’’
বিহার, উত্তরপ্রদেশেও নতুন নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে বিক্ষিপ্ত ভাবে বিরোধিতা শুরু হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ ভাবে এমন বিরোধিতার প্রয়োজন আছে বলেই মনে করেন নিজেদের মুলুক ছেড়ে কলকাতায় খেটে খেতে আসা মানুষগুলি। আর তাই এ দিন মিছিলে হাঁটবেন বলে সকালেই তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিলেন রেড রোডে। নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পোস্টার ঝুলিয়ে তাঁরা হাঁটলেন জোড়াসাঁকো পর্যন্ত। শুধু ফলপট্টিই নয়, জাকারিয়া স্ট্রিট, টেরিটিবাজার, ক্যানিং স্ট্রিট ও কলুটোলার মতো বিভিন্ন জায়গায় এ দিন কাজ বন্ধ রেখে মোটবাহকেরা পা মিলিয়েছিলেন মিছিলে। তাঁদের সঙ্গ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। তাঁদেরই এক জন মহম্মদ আক্রম হোসেন বললেন, ‘‘গঙ্গা-যমুনা সবই তো আমাদের দেশের। সেখানে বিভেদ কেন? মেছুয়া তো ছোটখাটো ভারতবর্ষ। ঘুরে দেখুন, জাত-ধর্ম নয়। এখানে সবাই ভাই-ভাই।’’
ঠাকুরদা ও বাবার মতোই ১৮ বছর বয়সে বেগুসরাই থেকে মেছুয়ায় চলে এসেছিলেন মহম্মদ মতিম। এ দিন মিছিল থেকে ফিরে কোনও মতে একটু খাবার খেয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন তিনি। মিছিল-ফেরত সহকর্মীদের আলোচনা শুনে থমকে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ। প্রশ্ন করলেন, ‘‘কীসের এত বিভেদ। আমার রক্ত কি আলাদা?’’ মতিমের কথা শুনে মুচকি হাসলেন ফল বাজারে পরিবহণ ব্যবসায়ী তথা ‘লাইট গুডস ভেহিক্লস, মেছুয়া বাজার ইউনিট’-এর সম্পাদক ভরত সিংহ। মহম্মদ আক্রম হোসেন ও ভরত একযোগেই প্রশ্ন করলেন, ‘‘স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ভারতের মাটিতে মিশে থাকা রক্ত হিন্দু না মুসলিমের? আলাদা করতে পারবেন কি?’’