রয্যাল বেঙ্গল টাইগার। —ফাইল চিত্র।
বাঘের হানায় প্রায়ই প্রাণ হারাচ্ছেন সুন্দরবনের মানুষ। এমন নয় যে এর আগে বাঘে-মানুষে সংঘাতের ঘটনা ঘটত না। কিন্তু গত দেড় বছরে সংখ্যাটা দ্রুত বেড়ে চলেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ২৫ জন মৎস্যজীবী লকডাউনের পর থেকে গত দেড় বছরে জঙ্গলে মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে বাঘের হামলায় মারা গিয়েছেন। জখম আরও বেশি। বেশ কয়েকজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাঘের আক্রমণের মুখ থেকে অনেককে বাঁচিয়ে এনেছেন সঙ্গীরা।
গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সচরাচর বছরে ৫-৭ জন বাঘের হামলায় প্রাণ হারাতেন। কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল, বাঘের হানার সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে?
গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, লকডাউনে কাজ হারিয়ে অনেকেই ভিন্ রাজ্য থেকে ফিরেছিলেন গ্রামে। বিকল্প কর্মসংস্থান তেমন মেলেনি। ফলে জঙ্গলমুখী হয়েছেন তাঁরা। জল-জঙ্গল সম্পর্কে উপযুক্ত তালিম অনেকেরই নেই। এঁরা বাঘের হামলার শিকার হয়েছেন কেউ কেউ। লকডাউনে স্থানীয় ভাবেও রোজগারপাতি খারাপ হয়েছে অনেকের। তাঁরাও বাড়তি রোজগারের আশায় জঙ্গলে যাচ্ছেন মাছ-কাঁকড়া ধরতে। আমপান, বুলবুল, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে যতটুকু চাষবাস হত এলাকায়, তা-ও ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষিজীবী বহু মানুষও জঙ্গলে যাচ্ছেন। এঁদের কারও জঙ্গলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নেই বলে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে মত স্থানীয় মানুষজনের।
পরিস্থিতির কথা মানছেন সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিনও। তিনি বলেন, ‘‘বার বার আমরা মৎস্যজীবীদের বিভিন্ন ভাবে সতর্ক করছি। সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকতে বারণ করছি। ঢুকলে জরিমানা করছি, নৌকো আটকে রাখছি। কিন্তু তবুও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত বন দফতরের চোখে ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ভাবে জঙ্গলে ঢুকে নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন।” সুন্দরবনের প্রান্তিক এলাকায় মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাব বরাবরই। দীর্ঘদিন বন দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে বাঘ নিয়ে কাজ করেন ডব্লুডব্লুএফের প্রধান অনুরাগ দণ্ড। তাঁর মতে, ‘‘মানুষ বাঘের এলাকায় ঢুকে পড়ছে বলেই সংঘাত বাড়ছে। আগে যে পরিমাণ মানুষ মাছ-কাঁকড়া-মধু সংগ্রহ করতে জঙ্গলে যেতেন, করোনা পরিস্থিতিতে আরও বেশি মানুষ এই কাজে যাচ্ছেন। তাই আগের থেকে বাঘে-মানুষে সংঘাতের ঘটনা বেশি ঘটছে।”
সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে অনেকদিন ধরে কাজ করছেন একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান জয়দীপ কুণ্ডু। তিনি বলেন, ‘‘মানুষ আরও বেশি জঙ্গলনির্ভর হয়ে পড়ার ফলেই দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। ভিন্ রাজ্য থেকে এলাকায় ফিরে অনেকে বিকল্প কাজ না পেয়ে জঙ্গলে যাচ্ছেন। তা ছাড়া, একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় সুন্দরবনের মানুষকে আরও বেশি জঙ্গলনির্ভর করে তুলেছে।’’ তাঁর মতে, বাঘ আছে নিজের ডেরাতেই। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে মানুষই সেখানে পা রাখছে। আর বাঘের মুখে সহজ ‘শিকার’-এ পরিণত হচ্ছে। বিকল্প কর্মসংস্থানই পরিস্থিতি বদলাতে পারে বলে মনে করেন জয়দীপ।
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাশাপাশি বন দফতরের তরফেও মৎস্যজীবীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের মাধ্যমে একশো দিনের প্রকল্পে জবকার্ড করে দেওয়া হয়েছে। কুমিরমারি পঞ্চায়েতের প্রধান দেবাশিস মণ্ডল বলেন, ‘‘আসলে কাঁকড়া ধরতে পারলে প্রচুর রোজগার হয়। মাসের মধ্যে দু’সপ্তাহ কাজ করলেই মোটা টাকা আয় হচ্ছে। তাই বিকল্প কর্মসংস্থান, একশো দিনের কাজ— কিছুতেই উৎসাহ নেই এক শ্রেণির মৎস্যজীবীর। বিপদের আশঙ্কা জেনেও তাঁরা জঙ্গলে ঢুকছেন।’’
বিপদ জেনেও কেন যান কাঁকড়া ধরতে? মৎস্যজীবীদের দাবি, অমাবস্যা-পূর্ণিমার কটালে মৎস্যজীবীদের তিন-চারজনের ছোট একটি দল প্রায় দেড় লক্ষ টাকার কাঁকড়া ধরে। দু’টি কটাল মিলিয়ে এক একজন মৎস্যজীবী মাসে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টাকা উপার্জন করে থাকেন। গোসাবা ব্লকের লাহিড়ীপুরের বাসিন্দা রবিন সর্দার, অমৃত মণ্ডলদের বক্তব্য, ‘‘মাছের বদলে কাঁকড়া ধরতে পারলেই বেশি রোজগার হয়। বিপদের ঝুঁকি থাকলেও কাঁকড়া ধরতে জঙ্গলে যাই আমরা। দু’টো বাড়তি রোজগার কে না চায়!’’
লকডাউনে ভিন্ রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে এলাকায় ফিরে কাঁকড়া ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন সুমন তরফদার, গোষ্ঠ মণ্ডলরা। তাঁরা জানালেন, এলাকায় সে ভাবে কোনও কাজ নেই। একশো দিনের কাজে আয় সামান্যই। তা-ও সারা বছর কাজ মেলে না। তাই বিপদের ঝুঁকি জেনেও কাঁকড়া ধরতে যান।
গত দেড় বছরে প্রায় ২৫ জন মৎস্যজীবী বাঘের হানায় মারা গিয়েছেন। জখম হয়েছেন অনেকে। নিখোঁজ কেউ কেউ। লকডাউনে কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে বিকল্প কর্মসংস্থান মেলেনি অনেকের। জঙ্গলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ও তালিম না থাকলেও তাঁরা যাচ্ছেন মাছ-কাঁকড়া ধরতে। বিপদের মুখেও পড়ছেন।আমপান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে চাষবাসে ক্ষতি হয়েছে। তারপর থেকেও অনেকে জঙ্গলে যাচ্ছেন বাড়তি রোজগারের আশায়।