সোমেন মিত্র
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের জীবনাবসান হয়েছে। বুধবার গভীর রাতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ কলকাতায় একটি নার্সিংহোমে তিনি প্রয়াত হন। বয়স হয়েছিল ৭৮। বৃহস্পতিবার নিমতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
সোমেনবাবু দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। পেসমেকারও ছিল। সেই সংক্রান্ত চিকিৎসার জন্য তিনি কয়েক দিন আগে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বেশি দেখার পরে ডায়ালিসিস করা হয়। তার পর ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। বুধবার সন্ধ্যায় তিনি হাঁটাচলা করেছিলেন। পরিজনদের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। তার পর অকস্মাৎ হৃদ্রোগের আক্রমণ। তাঁর স্ত্রী শিখাদেবী তৃণমূলের বিধায়ক ছিলেন। ছেলে রোহন যুব কংগ্রেসের সহ-সভাপতি।
দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে যাওয়া সোমেনবাবুকে ২০১৮ সালে অধীর চৌধুরীর জায়গায় প্রদেশ সভাপতি করেন রাহুল গাঁধী। কেন, তা নিয়ে আলোচনা চলেছিল সর্বস্তরে। সোমেনবাবু নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। অনেকের ধারণা, প্রদেশ কংগ্রেসের নিজস্ব খরচ জোগাড় করে দল চালানোর জন্য অন্য কারও নাম নেতৃত্বের সামনে ছিল না।
এর আগে ১৯৯২ সালে সাংগঠনিক নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামান্য ভোটে হারিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন সোমেনবাবু। দু’দফায় ১৯৯৮ পর্যন্ত সেই পদে ছিলেন। প্রদেশ কংগ্রেসের বর্তমান কার্যালয় বিধান ভবনও তৈরি তখনই। ১৯৯৮ সালে লোকসভা ভোটে মমতার নবগঠিত তৃণমূলের উত্থান দেখে সোমেনবাবু ‘পদত্যাগ’ করেছিলেন। পরে অবশ্য নিজেই তৃণমূলে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে ডায়মন্ড হারবার থেকে সাংসদ হন।
আরও পড়ুন: প্রিয়দা নেই, সোমেনও অতীত, যুগ ফুরোচ্ছে, লিখলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়
প্রবীণ নেতার প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা-সহ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় শোকপ্রকাশ করেছেন। শোক জানিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কা বঢরা, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত, শচীন পাইলট, কেরলের বিরোধী দলনেতা রমেশ চেন্নিথালা, এআইসিসি-র মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা প্রমুখ। দিল্লি থেকে সরাসরি কলকাতার উড়ান এ দিন না থাকায় শেষকৃত্যে এআইসিসির কেউ আসতে পারেননি। বাংলার ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি নেতা গৌরব গগৈ রাতে দিল্লি থেকে গুয়াহাটি হয়ে শহরে এসে সোমেনবাবুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শোকবার্তায় বলেছেন, ‘‘সোমেনবাবুর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পরিচয় এবং হৃদ্যতা ছিল। এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতার মৃত্যুতে বাংলার রাজনৈতিক জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল।’’ প্রণববাবু বলেছেন, ‘‘সোমেনের রাজনীতির প্রথম দিক থেকে আমি ওঁকে চিনি। দৃঢ় চরিত্রের মানুষ। যে কোনও ঘটনায় বড় ছবিটা ও দেখতে জানত। দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং বন্ধুকে হারালাম।’’
আরও পড়ুন: প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে এ বার কে?
সোমেনবাবুকে দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে উল্লেখ করে সনিয়া বলেছেন, ‘‘তাঁর মৃত্যুতে বাংলা এবং কংগ্রেস শক্তির এক স্তম্ভকে হারাল।’’ রাহুল তাঁর বার্তায় সোমেনবাবুর প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘সোমেনদা আমার রাজনৈতিক অভিভাবক ছিলেন। আমার কংগ্রেস রাজনীতিতে আসা, দলে সুযোগ পাওয়া, জনপ্রতিনিধি হওয়া— এ সবই সোমেনদার অবদান। তাঁর মৃত্যুতে বাংলায় কংগ্রেসের একটা অধ্যায় সমাপ্ত হল।’’ শোক জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান।
বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিংহ, মুকুল রায় এবং সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তী, মনোজ ভট্টাচার্য, নরেন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বাম নেতা শোক জানিয়েছেন। বিধান ভবনে সোমেনবাবুকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন বাম শিবিরের সূর্যবাবু, নরেনবাবু, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, মনোজবাবু প্রমুখ এবং বিজেপির সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, জয়প্রকাশ মজুমদার-সহ চার জন। রাহুল এবং মুকুল যান সোমেনবাবুর আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘রাজনীতির জগতে অভিভাবকতুল্য সোমেনবাবু ছিলেন সৌজন্যের রাজনীতির প্রতিভূ। এ ধরনের মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে সৌজন্যের সংস্কৃতিও কমে আসছে।’’ মুকুল টুইট করেন, ‘‘বামেদের অপশাসন এবং হিংসার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি ছিলেন বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সোমেনদার স্মৃতি অমর।’’ বিমানবাবু বলেন, ‘‘রাজ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলায় সোমেনবাবুর বড় ভূমিকা ছিল।’’
সোমেনবাবুর মরদেহ নার্সিংহোম থেকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় বিধান ভবনে। সেখান থেকে বিধানসভা, লোয়ার রডন স্ট্রিটে তাঁর বর্তমান বাসভবন এবং ৪৫, আমহার্স্ট স্ট্রিটের পুরনো বাড়ি হয়ে মরদেহ পৌঁছয় নিমতলা মহাশ্মশানে। বিধানসভায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু মরদেহ পৌঁছতে দেরি হওয়ায় মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও তাপস রায়কে রেখে তিনি চলে যান। স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ মন্ত্রী ও বিরোধী নেতারা সেখানে প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।