খড়দহ স্টেশনের ঘটনার পরে বিরাটিতে ট্রেন অবরোধ পুরুষ যাত্রীদের।
সকাল সাড়ে ৮টায় গোবরডাঙা থেকে ট্রেনে উঠেছিলাম অফিস আসব বলে। চাঁদনি চকের অফিসে পৌঁছলাম যখন, তখন দুপুর ২টো। রেলপথে যার দূরত্ব ৫৬ কিমি আর সড়ক পথে ৭০ কিমি। মছলন্দপুর থেকেই ফোনে খবর আসছিল, বামনগাছিতে অবরোধ। শেষে বিড়া স্টেশনে আটকে গেলাম।
বিড়ার দু’টো স্টেশন আগে থেকে অবরোধের খবর আসছিল মোবাইলে। এমনকী, হোয়াট্সঅ্যাপে অবরোধের ছবিও পাঠাচ্ছিল বন্ধুরা। তখনও বুঝিনি দুর্ভোগের কতটা বাকি রয়েছে। আগের ট্রেনগুলোয় যে সব বন্ধুরা ছিল, তাদের ফোন করে জানলাম, ট্রেন যে এগোবে, তেমন সম্ভাবনা কমই। এমনকী, রেলের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমেও বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, বামনগাছিতে অবরোধ হওয়ায় আপাতত আপ-ডাউন লাইনে কোনও ট্রেন চলাচল করতে পারছে না। অবরোধ উঠলে জানিয়ে দেওয়া হবে। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যেই দাঁড়িয়েছিলাম। ঠাসা ভিড়টা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করল। একটা সময় প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল ট্রেন। যাত্রীদের ভিড় জড়ো হল চালকের কেবিনের সামনে। কেবিনের অদূরে রেলগেট। খোলা সেই রেলগেট থেকে অটো এবং ভ্যানরিকশা চালকেরা বোঝাই গাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন যশোহর রোডের দিকে। ঘণ্টাখানেক সেখানে দাঁড়িয়ে তারই একটাতে উঠলাম। যশোহর রোডে যেতে ভাড়া চাইল দশ টাকা মাথা পিছু। দ্বিগুণ ভাড়া।
যশোহর রোডে তখন তিলধারণের জায়গা নেই। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। তারই মধ্যে বোঝাই হয়ে এগোচ্ছে বাস, টোটো, অটো, টেম্পো।
বিড়া চৌমাথায়, যশোহর রোডে দেখা পুরনো স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে দেখা। বারাসতে তাঁর স্কুল। আমাকে দেখে বললেন, ‘‘কোথায় যাবি?’’ বললাম, কলকাতার চাঁদনি চকে। তিনি বললেন, ‘‘একটু দাঁড়া, স্কুল থেকে গাড়ি আসবে। তাতেই বারাসত চলে যাব। সেখান থেকে কিছু একটা ধরে কলকাতা যেতে পারবি।’’ আশ্বস্ত হলাম। কিছু ক্ষণ পরে শিক্ষকের স্কুল থেকে পাঠানো গাড়ি এল। মুহূর্তের মধ্যে তাতে উঠে পড়ল একগাদা লোক। আমরাও কোনওগতিকে উঠলাম। জাতীয় সড়কে ভিড় বলে চালক পাশের একটি গলিপথে গাড়ি থামালেন। শিক্ষকের সঙ্গে আমাকে গাড়িতে রেখে চালক নামিয়ে দিলেন বাকিদের। গ্রামের রাস্তায় অন্যদের নামিয়ে বারাসত যেতে ভাল লাগছিল না তখন। বারাসতে যখন নামলাম তখন ভিড়টা যেন চেপে বসেছে রাস্তায়। খবর এল মধ্যমগ্রাম, বিরাটি, হৃদয়পুর, দত্তপুকুর— সর্বত্র অবরোধ চলছে।
অবরোধকারীদের বোঝানোর চেষ্টা পুলিশের
বারাসতে নেমে দেখলাম অনেকে একটি অ্যাম্বাসাডরের দিকে ধেয়ে যাচ্ছেন। আমিও সেই দলে সামিল হলাম। ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার উপরে। কোনওমতে পিছনের সিটে জায়গা হল। কোথায় যাব, বলা হয়নি। চালক জিজ্ঞেস করতেই তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ‘‘আপনি কোথায় যাবেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘এয়ারপোর্ট।’’’ এয়ারপোর্ট নেমে আবার হা-হুতাশ। কিছুই নেই। যে ট্যাক্সিই ধরতে চাই, সবেতেই লোক ভর্তি। শেষে একটিতে প্রায় জোর করে উঠতে চাইলাম। চালক গজগজ করছেন। পিছনের যাত্রীকে বললাম, ‘‘অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। রেল অবরোধ। অফিস পৌঁছতেই হবে।’’ ওই যাত্রী হাওড়া যাবেন। বোধহয় বুঝতে পারলেন আমার দুঃখ। চালককে বললেন, ‘‘নিয়ে চলুন।’’ তাঁর দয়ায় পৌঁছলাম বেলগাছিয়া মেট্রো স্টেশন। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে চালকের হাতে গুঁজে দিলাম ১০০ টাকার একটি নোট। ১টা ৩৭-এর মেট্রোয় চেপে চাঁদনি যখন নামলাম, তখন ২টোর কাঁটা ছুঁইছুঁই।
মোবাইলে খবর এল, তখনও স্বাভাবিক হয়নি ট্রেন চলাচল।
আরও নিত্যযাত্রীর অভিজ্ঞতা
বনগাঁর শক্তিগড় এলাকার বাসিন্দা কৃষ্ণেন্দু পালিত। পেশায় স্কুল শিক্ষক। নাগেরবাজারের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সকাল ৮টা ৩২ মিনিটের বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল ধরেন। এ দিনও ট্রেনে চেপেছিলেন। অশোকনগর স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন এসেছে স্বাভাবিক গতিতেই। বিপত্তিটা বাধল যখন, ঘড়িতে তখন সময় ৯টা ১৫ মিনিট। বেলা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও ট্রেন চলেনি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন বেলা প্রায় ২টো। ট্রেন বন্ধ থাকায় অশোকনগরে নেমে বাস ধরেন সঞ্জয় পাল। ভিড়েঠাসা বাস ধরে পৌঁছন মধ্যমগ্রামে। কিন্তু কাশীপুরের গন্তব্যে সময় মতো পৌঁছতে পারবেন না বুঝে ফিরতি পথ ধরেন। কবি বিভাস রায়চৌধুরী কর্মসূত্রে রোজ কলকাতায় যান। ৯টা ৫০ মিনিটের বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল ট্রেন ধরার কথা ছিল। বনগাঁয় এসে সকাল ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে জানতে পারেন ৮টা ৩২ মিনিটের বনগাঁ-শিয়ালদহ লোকাল ট্রেন তখনও অশোকনগরে দাঁড়িয়ে আছে। বাধ্য হয়েই তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। হাবরা, অশোকনগর, দত্তপুকুর, গুমা থেকে ট্রেন ধরে এমনই নাকাল হতে হয়েছে যাত্রীদের।
বুধবার সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।