একাধিক জেলায় টহলদারি শুরু করে দিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। —ফাইল চিত্র।
আদামী ৮ জুলাই রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে, শুক্রবার থেকেই একাধিক জেলায় টহলদারি শুরু করে দিল কেন্দ্রীয় বাহিনী। পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন এবং প্রত্যাহার পর্বে রাজ্য জুড়ে হিংসার বাড়বাড়ন্তের অভিযোগ ছিল বিরোধীদের। ভোট এবং গণনার সময় তার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বহু টানাপড়েনের পর কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রের কাছে ‘রিক্যুইজিশন’ পাঠায় রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেই অনুযায়ী বাহিনীর আগমণও শুরু হয়ে গিয়েছে শুক্রবার থেকে। অন্য দিকে, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, গণনার পর আরও ১৫ দিন থাকুক কেন্দ্রীয় বাহিনী। এই দাবি তিনি জানিয়ে এসেছেন নির্বাচন কমিশনকে। তবে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দাবি মেনে এক লপ্তে ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠাচ্ছে না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। শুক্রবার পর্যন্ত ৩১৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠানোর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে অমিত শাহের মন্ত্রক। এর ফলে জল্পনা তৈরি হয়েছে, তা হলে কি পঞ্চায়েত ভোট একাধিক দফায় করার ‘চাপ’ দিতেই একসঙ্গে সব বাহিনী পাঠাচ্ছে না কেন্দ্র? একই সঙ্গে অবশ্য আদালতে খানিকটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে কমিশন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক রাজ্যের স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করবেন বলে কমিশনকে নোটিস দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে হাই কোর্টে যায় কমিশন। সেই মামলায় শুক্রবার হাই কোর্ট জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওই নোটিস খারিজ করে দেয়। পাশাপাশি, পঞ্চায়েতে নথি বিকৃতকাণ্ডে আপাতত সিবিআই কোনও পদক্ষেপ করতে পারবে না বলে শুক্রবার জানায় হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
বাংলায় এল বাহিনী
প্রথমে ২২ কোম্পানি, তার পরে আরও ৮০০ কোম্পানি। মোট ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে ‘রিক্যুইজিশন’ পাঠিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফায় চাওয়া ২২ কোম্পানি বাহিনী কোন কোন জেলায় মোতায়েন হবে, তার তালিকা প্রকাশ করেছেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা)। প্রথমে ২২ জেলায় ২২ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েন করা হবে। তার পর ধাপে ধাপে যে পরিমাণ বাহিনী আসবে, তাদের মোতায়েন করা হবে রাজ্যের জেলায় জেলায়। প্রথম ধাপে যে সব জেলায় ২২ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে, সেগুলি হল— আলিপুরদুয়ার, বাঁকুড়া, বীরভূম, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, দার্জিলিং, হুগলি, হাওড়া, জলপাইগুড়ি, ঝাড়গ্রাম, কালিম্পং, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর দিনাজপুর। শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, জলপাইগুড়ি, আরামবাগ, বাঁকুড়ায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ‘এরিয়া ডমিনেশন’ করতে নেমে পড়েছে। ঝাড়গ্রামে আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। তারা ঝাড়গ্রামের পঞ্চায়েত এলাকায় টহলদারি শুরু করে দিয়েছে। সূত্রের খবর, শনিবার রাজ্যের সব জেলাতেই এরিয়া ডমিনেশনের কাজ শুরু করে দেবে বাহিনী।
কমিশনের উপর বাহিনী-চাপ বিজেপির
শুক্রবার পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে শুভেন্দু দাবি করেন, গত বিধানসভা ভোট মিটে যাওয়ার পর অভূতপূর্ব হিংসার সাক্ষী হয়েছিল বাংলা। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পঞ্চায়েত ভোট মিটলেই যেন বাহিনী প্রত্যাহার করা না হয়। শুভেন্দু বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের গণনার পর বিধানসভা ভোট পরবর্তী ঘটনার পুনরাবৃত্তি রুখতে ১৫ দিন রাজ্যে সশস্ত্র বাহিনী রাখতে হবে।’’
ধাপে ধাপে বাহিনী কিসের ইঙ্গিত?
বহু টানাপড়েনের পর ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফায় কমিশন ২২ কোম্পানি বাহিনী চেয়েছিল। অর্থাৎ মোট ৮২২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে কমিশন। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এখনও পর্যন্ত ৩১৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠানোর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। রাজ্যের বিজেপি নেতারা দাবি করছেন, কোনও সরকারের পক্ষেই একসঙ্গে ৮০০ কোম্পানি বাহিনী দেওয়া সম্ভব নয়। এর পরেই জল্পনা তৈরি হয়েছে, তা হলে কি একাধিক দফায় পঞ্চায়েত ভোট করানোর ‘চাপ’ দিতেই একলপ্তে সব বাহিনী পাঠাচ্ছে না অমিত শাহের মন্ত্রক? যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী, অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল অশোককুমার চক্রবর্তী শুক্রবার এই সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানিতে জানান, রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে সংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে, তা দিতে কোনও অসুবিধা নেই।
বাহিনী নিয়ে আদালত অবমাননা?
পঞ্চায়েত ভোটে হিংসা ঠেকাতে গত ১৩ এবং ১৫ জুন কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ যে নির্দেশ দিয়েছিল তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ করে হাই কোর্টেই পিটিশন দাখিল করেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং মালদহের কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)। মামলার শুনানিতে শুক্রবার প্রধান বিচারপতির বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্যের প্রায় ২০,৫৮৫ আসনে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শুক্রবারই দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-১ ব্লকে মনোনয়ন প্রত্যাহার সংক্রান্ত একটি মামলার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। এই প্রেক্ষিতেই প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি উদয় গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, আগামী ২৭ জুনের মধ্যে কমিশনকে সমস্ত বিষয়ে হলফনামা জমা দিতে হবে। ২৮ জুন এই মামলার পরবর্তী শুনানি।
হাই কোর্টে স্বস্তি কমিশনের
পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসার অভিযোগের প্রেক্ষিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নোটিস দিয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। তাতে জানানো হয়েছিল, মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক হিসাবে কমিশনের ডিজি (তদন্ত) রাজ্যের স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করবেন। মানবাধিকার কমিশনের এই নোটিসকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয় নির্বাচন কমিশন। শুক্রবার সেই মামলায় এই দফায় সম্ভবত প্রথম স্বস্তি পেল তারা। শুক্রবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওই নোটিস খারিজ করে দেন বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য। মানবাধিকার কমিশনের ডিজি স্পর্শকাতর এলাকা চিহ্নিত করতে পারবেন না বলেও নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
নথিকাণ্ডে সিবিআই স্থগিত
পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাওয়া হাওড়ার উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের কাশ্মীরা বিবি, ওমজা বিবির মনোনয়নপত্র বিকৃত করার অভিযোগ উঠেছিল বিডিও-র বিরুদ্ধে। মামলাকারীদের অভিযোগ, নথি বিকৃত করার ফলেই স্ক্রুটিনি থেকে বাদ চলে যায় এই প্রার্থীদের নাম। বিডিও-র কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েও কাজ হয়নি বলে দাবি। তা নিয়েই মামলা হয় হাই কোর্টে। বিচারপতি অমৃতা সিংহ সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশের উপর আপাতত স্থগিতাদেশ জারি করল বিচারপতি অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিচারপতি অপূর্ব সিংহের ডিভিশন বেঞ্চ। আগামী সোমবার দুপুর ২টোয় এই মামলার রায় ঘোষণা।