চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (বাঁ দিকে) এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
‘দুয়ারে’ লোকসভা ভোট। তাই ভোট-মেশিনে ‘কড়কড়ে লাভ’ দেওয়া সামাজিক প্রকল্পগুলিতে বরাদ্দে রাজ্য সরকার যে এ বার কল্পতরু হবে, তা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন ছিল, বিপুল ধারের বোঝা চেপে থাকা এই টানাটানির সংসারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই টাকা জোগাড় করবে কোথা থেকে? বৃহস্পতিবার অর্থ দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এ বারের রাজ্য বাজেট পেশ করার পরে সেই প্রশ্নই আরও জোরালো ভাবে তুলতে শুরু করল বিরোধী শিবির। অর্থনীতি-বিশ্লেষক এবং শিল্প মহলের একাংশের মতেও, গরিব মানুষের হাতে টাকা জোগানো সরকারের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তা বলে ‘ধার করে ঘি খাওয়ার’ বহর ক্রমাগত বাড়াতে থাকলে, দীর্ঘ মেয়াদে তার ফল দুশ্চিন্তার।
এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এত আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও বাংলা দেখিয়ে দিয়েছে, কী করে এগিয়ে যেতে হয়। ...এটা চমকে যাওয়ার মতো বাজেট।’’ কিন্তু অর্থনীতি-বিশ্লেষক তথা বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ীর কটাক্ষ, “অনুদান দেওয়ার জাদুদণ্ড সরকারের হাতে। অনেকটা পি সি সরকারের মতো। কিন্তু এত অনুদানের কথা বলা হলেও, আয়ের দিশা নেই।” তাঁর দাবি, “সেই কারণেই মূলধনী খাতে ব্যয় কমেছে। এই বাজেট সর্বনাশা। পরের সরকারের কাছে আর কিছুই থাকবে না।” বেলাগাম ধার নিয়ে বিঁধেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও। কিন্তু ‘ধার করে ঘি খাওয়া’র অভিযোগ কেন তুলছেন বিরোধীরা?
বাজেট-তথ্য অনুযায়ী, আগামী আর্থিক বছরে পুঞ্জীভূত ঋণের বোঝা বাড়বে আরও ৬২ হাজার কোটি টাকা। পৌঁছবে প্রায় ৬.৯৩ লক্ষ কোটি টাকায়। আগামী বছরের বাজেটে শুধু বাজার থেকেই ৭৯,৭২৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমান করছে সরকার। এ বছরের (সংশোধিত হিসাব) তুলনায় যা প্রায় ৬৭২৭ কোটি টাকা বেশি। সেই হিসাবে শুধু সুদে-আসলেই প্রায় ৭৬,৬৯৬ কোটি টাকা মেটাতে হবে সরকারকে। প্রশ্ন উঠছে, বছরের পর বছর ঋণের বোঝা এ ভাবে বাড়তে থাকা সামাল দেওয়া যাবে কত দিন?
এই চিন্তা খানিকটা কম হত রাজ্যের নিজস্ব আয় দ্রুত বাড়লে। কিন্তু বাজেট নথিই দেখিয়ে দিচ্ছে, বাড়তি খরচের ধাক্কা সামলাতে ধারের পাশাপাশি খানিকটা যেন কেন্দ্রের মুখের দিকেও তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে রাজ্যকে। এমনিতে একশো দিনের কাজের টাকা থেকে করের ভাগ— বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রের বঞ্চনার কথা বলে রাজ্য। কিন্তু বাজেট-নথি বলছে, আদতে মোদী সরকারের কাছ থেকে বেশি টাকা আসার বিষয়ে প্রত্যাশী তারা। যেমন বাজেটে আশা, কেন্দ্রের অনুদানের অঙ্ক ২৯,৫৭৫ কোটি থেকে বেড়ে হবে ৩৪,৬৮৪ কোটি টাকা। যদিও চলতি বছরে তা কমেছে ১১,২৪৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের শুরুতে বাজেটে যা অনুমান ছিল, তার তুলনায় (সংশোধিত হিসাবে) রাজ্যের নিজস্ব কর আদায় বেড়েছে ৪১৪৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে আবগারি খাতে বেড়েছে ৯৩০ কোটি। কিন্তু অনুমানের থেকে কমেছে বিক্রয়কর (প্রধানত, পেট্রল-ডিজ়েল বিক্রি বাবদ)। অথচ সেখানে রাজ্যের জিএসটি (এসজিএসটি) বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। একই সূত্রে রাজ্যের পাওয়া কেন্দ্রীয় করের ভাগ বাবদ অর্থও বেড়েছে প্রায় ৬৩০০ কোটি টাকা। আশা, এ বার ওই খাতে মিলবে ৯২,৯০০ কোটি।
আয়ের তুলনায় ব্যয়ের অঙ্ক বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই চওড়া হওয়ার সম্ভাবনা ঘাটতি। নতুন অর্থবর্ষে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব বেড়ে হওয়ার কথা প্রায় ১.০২ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি বছরে কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্য মিলিয়ে মোট রাজস্বের অনুমান ছিল প্রায় ২.১২ লক্ষ কোটি। কিন্তু সেই জায়গায় (সংশোধিত হিসাবে) তা হয়েছে ২.০৮ লক্ষ কোটি টাকা। এই অবস্থায় নতুন বছরে প্রায় ২.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব মিলবে বলে অনুমান রাজ্যের। সেখানে সম্ভাব্য রাজস্ব খরচ প্রায় ২.৬৮ লক্ষ কোটি। ফলে আগামী বছরে সম্ভাব্য রাজস্ব ঘাটতি ৩১,৯৫১ কোটি টাকা। নতুন আর্থিক বছরে বিপুল ঘোষণার প্রতিফলন রাজকোষ ঘাটতিতেও। আগামী আর্থিক বছরে তা পৌঁছতে পারে ৬৮,২৫০ কোটি টাকায়। যা এ বছরের সংশোধিত হিসাবের থেকে প্রায় ৮৯০০ কোটি টাকা বেশি।
বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্যে বিনিয়োগে খরা। বড় শিল্প সে ভাবে বহু বছর আসেনি। তাই কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়েনি নিজস্ব রাজস্ব। তার খেসারত হিসেবে বেড়েছে ঘাটতি, ঋণের বহরও। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে জানাচ্ছেন, এ বার বাধ্য হয়েই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দফতরের বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজনের তুলনায় কম। মুখ্যমন্ত্রীর ‘কাছের’ বলে পরিচিত কিছু প্রকল্পের বরাদ্দও কমাতে হয়েছে। যেমন, স্বাস্থ্য দফতরের বরাদ্দ বেড়েছে ১৫৮৭ কোটি টাকা। পূর্ত দফতরের ৩৪৩ কোটি এবং পুর-নগরোন্নয়নে ৫১০ কোটি। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ১৭৬ কোটি, রূপশ্রীতে প্রায় ৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ কমেছে।
এ দিন পেশ করা ৩,৬৬,১১৬ কোটি টাকার বাজেট দেখে বিরোধীদের কটাক্ষ, ভোট-বছরে এ আসলে ঋণের টাকায় খয়রাতি। তবে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘‘সংসার চালাতে গেলে আগে টাকার সংস্থান করতে হয়। কতটা টাকা পাওয়া যাবে, তা ভাবতে হয়।’’ তাঁর ইঙ্গিত, সে ভাবেই বাজেট করেছে তাঁর সরকার।