ফাইল চিত্র।
প্রথম ঘোষণা করেছিলেন ১০ বছর আগেই। রাজ্যে তৃতীয় বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে এ বার মন্ত্রিসভায় পাশ হয়েছে বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব। বাংলায় ৫০ বছরেরও বেশি আগে লুপ্ত হয়ে যাওয়া বিধান পরিষদ আবার ফিরিয়ে আনার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। এমন সিদ্ধান্তকে ‘সাদা হাতি পোষার শামিল’ আখ্যা দিয়ে বিরোধিতায় গিয়েছে বামেরা। সরাসরি সমর্থন বা বিরোধিতা না করে পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিজেপিও।
তৃণমূল প্রথম বার ক্ষমতায় আসার পরে বিধান পরিষদ গড়ার লক্ষ্যে বিধানসভায় এক বার সরকারি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। বিরোধিতাই করেছিল বামেরা। পরে সেই প্রস্তাব একটি কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন আর বিষয়টি এগোয়নি। সেই সময়ের বিরোধী দলনেতা এবং সিপিএমের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের মতে, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর পথে হেঁটে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় না করে রাজ্য সরকারের উচিত সঙ্কটাপন্ন মানুষকে চিকিৎসা, খাদ্য ও রোজগারে সাহায্য করা।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘করোনা অতিমারির পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বাড়ানোই এখন প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। অথচ রাজ্য সরকার শাসক দলের কয়েক জনকে পিছনের জরজা দিয়ে পুনর্বাসন দিতে বিধান পরিষদ গঠনের নামে সাদা হাতি পোষার ব্যবস্থা করতে চাইছে। এর বিশাল খরচ জনগণের ঘাড়ে চাপবে।’’ আর এক প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের আব্দুল মান্নান মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সাম্প্রতিক অতীতে তামিলনাড়ু তাদের রাজ্য বিধান পরিষদ গঠনের জন্য প্রস্তাব পাঠালেও কেন্দ্রীয় সরকার তাতে অনুমোদন দেয়নি। সংসদেও বিষয়টি নিয়ে যাওয়া হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধান পরিষদের পুনরুজ্জীবন অপ্রয়োজনীয় বলে তাঁরও মত।
শাসক দলের নেতৃত্ব অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, জনতার ভোটে যাঁরা সরাসরি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, তার বাইরেও অনেক যোগ্য ব্যক্তিত্বকে আইনসভায় আনতে পারলে গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল। সংসদে যেমন লোকসভা ও রাজ্যসভা আছে, রাজ্য স্তরের আইনসভাতেও তেমন দুই কক্ষ থাকলে বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব আরও নিশ্চিত করা যায়। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট জনেদের নিয়ে আসার লক্ষ্যেই বিধান পরিষদ গড়তে চাওয়া হচ্ছে। কারা কী ভাবে সেই পরিষদে নির্বাচিত হবেন, সেই সব বিষয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। বিল আনার আগে বিশদে আমরা আলোচনা করব।’’ তৃণমূলের সাংসদ সুখেন্দু শেখর রায়ের বক্তব্য, ‘‘শুধু খরচ বা জটিলতা বাড়বে, এই যুক্তি দিয়ে বিষয়টাকে খারিজ করা ঠিক নয়। গণতন্ত্রে ভারসাম্য খুব জরুরি। বিধানসভার কাজে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে গেলে তার পর্যালোচনা করার সুযোগ বিধান পরিষদের থাকবে। ব্রিটেন বা আমেরিকায় দ্বি-কক্ষ আইনসভা এই কারণেই আছে।’’
সূর্যবাবুরা অবশ্য তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, রাজ্যে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত যে সময়ে বিধান পরিষদ ছিল, সেই সময়ে মোট ৪৩৬টি বিল পাশ হয়েছিল। তার মধ্যে দু’টি বাদে ৪৩৪টি বিলই হুবহু ছেড়ে দিয়েছিল বিধান পরিষদ। ভারতের মতো বৈচিত্রময় দেশে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্বের স্বার্থে রাজ্যসভা থাকতেই পারে কিন্তু রাজ্যের ক্ষেত্রে সেই যুক্তিও খাটে না। সেই সঙ্গেই সূর্যবাবু মনে করিয়ে দিয়েছেন, যুক্তফ্রন্ট আমলে ২২২ জন বিধায়কেরই (সে আমলের বিধানসভায় আসন-সংখ্যা) সমর্থনে বিধান পরিষদ যখন তুলে দেওয়া হয়, যতীন চক্রবর্তীর আনা প্রস্তাব সমর্থন করে কংগ্রেস নেতা সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় বলেছিলেন, ‘দক্ষ সার্জেন হিসেবে যতীনবাবু অ্যাপেনডিক্স অপারেশন শুরু করেছেন। সহকারী হিসেবে আমি তাতে সাহায্য করছি’। বিধানসভার কাজে দীর্ঘসূত্রিতা এবং খরচের প্রশ্নেই দ্বিতীয় কক্ষ গঠনের বিরোধিতা করছে এসইউসি এবং আরও কিছু বামপন্থী দল।
এই বিতর্কের প্রেক্ষিতেই রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘সিদ্ধার্থবাবুর পরম্পরা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভেঙে দিতে চাইছেন? গত ১০ বছরে যে বিধানসভায় একটাও মুলতুবি প্রস্তাব আলোচনার জন্য গৃহীত হয়নি, সেখানে বিধান পরিষদ এনে কী আর গণতান্ত্রিক পরিসর বাড়বে! রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং রাজকোষের উপরে চাপ বাড়িয়ে এই উদ্যোগের কী প্রয়োজন, তা বিবেচনা করা উচিত। আলোচনার সময়ে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।’’ প্রসঙ্গত, যে কয়েকটি রাজ্যে এখনও দ্বিতীয় কক্ষ রয়েছে, তার মধ্যে বিজেপি-শাসিত বিহার, উত্তরপ্রদেশও আছে।