বিক্ষোভরত চাকরিপ্রার্থীরা। ফাইল চিত্র।
দশমীর রাতে উত্তরবঙ্গের মাল নদীতে হড়পা বানে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। জখম অনেকে, কেউ কেউ নিখোঁজ। আবার কলকাতাতেই ময়দান চত্বরে টানা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন চাকরি-প্রার্থীরা। এই পরিস্থিতিতে সরকারি আয়োজনে দুর্গা প্রতিমার কার্নিভাল করা কত দূর শোভন ও সঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল বিরোধীরা। সরকার তথা শাসক দলের তরফে অবশ্য পাল্টা বলা হচ্ছে, এই কার্নিভালের প্রসার আন্তর্জাতিক স্তরের। উত্তরবঙ্গের বিপর্যয় এবং চাকরি-প্রার্থীদের সমস্যার ক্ষেত্রে যা করার, সরকার করছে। তাই কার্নিভাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা ‘সঙ্কীর্ণ রাজনীতি’ ছাড়া কিছু নয়।
যে সময় ও পরিস্থিতিতে আজ, শনিবার কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, তার মধ্যে ‘অসংবেদনশীলতা’ আছে বলে মনে করছে বামেরা। সমাজমাধ্যমে এই সংক্রান্ত আবেদনে সিপিএমের পলিটবুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, ‘‘কলকাতার পুজো উদ্যাক্তারা এক বার ভাবুন। আপনারা যখন আপনাদের প্রতিমা কার্নিভালে প্রদর্শিত করছেন, তখন সেই রাস্তার উল্টো দিকে এক দল মানুষ দিনের পর দিন উৎসব ও পরিবার থেকে বহু দূরে তাদের হকের দাবিতে রাস্তায় বসে আছে। অন্য দিকে, প্রশাসনের উদাসীনতায় মাল নদীতে হড়পা বানে মৃত্যু-মিছিল, নিখোঁজের সংখ্যা এখনও অধরা।’’ সেই সঙ্গেই প্রশ্ন, ‘‘এত অসংবেদনশীল বাংলা কি ছিল আমাদের?’’ ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখাও শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে আবেদন করেছে, ‘নদী প্লাবনে অনেক মানুষ প্রাণ হারাল, এ দিকে কলকাতায় ৫৭০ দিন ধরে চাকরি-প্রার্থীরা রাস্তায়। এই শোকের সময়ে সর্বত্র কার্নিভাল বাতিল করে সেই অর্থে বিপন্নদের সাহায্য করা হোক’।
একই ভাবে রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, ‘‘অসহিষ্ণু ও অমানবিক সরকার! খেলা, মেলা, মোচ্ছবের সরকার চলছে। মানুষের জীবন-যন্ত্রণা ও সার্বিক দুর্নীতি থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে কার্নিভালের আয়োজন। এর সঙ্গে দেবী দুর্গার অনেক দূর পর্যন্তও কোনও সম্পর্ক নেই।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায় বলেছেন, ‘‘শুধু জলপাইগুড়ির কার্নিভাল বন্ধ কেন? উত্তরবঙ্গের শোক কি সারা বাংলার নয়? রেড রোডের কার্নিভাল বন্ধ রাখা উচিত। তা না করে সরকার সুচারু রূপে বিভাজনের সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছে। যারা মনে করে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ ভাগ হওয়া উচিত, তারা রাজনৈতিক অস্ত্র পেয়ে যাবে!’’ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনও ‘ব্যয়বহুল’ কার্নিভাল বাতিলের ‘নাগরিক দাবি’কে সমর্থন করেছে।
বিরোধীদের যুক্তি খণ্ডন করে রাজ্যের মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম অবশ্য বলেছেন, ‘‘এই যে কার্নিভাল, তা শুধুই আমাদের উৎসব নয়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে রাজ্যের শিল্প-সংস্কৃতি, বাণিজ্য ইত্যাদি জড়িয়ে রয়েছে। তাই এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সঙ্কীর্ণ রাজনীতি ছাড়া কী!’’ দশমীর রাতে উত্তরবঙ্গে বিপর্যয়ের প্রশ্নে ফিরহাদের বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে সব রকম ভাবে সরকার আছে। প্রশাসনিক স্তরেও বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। এই রকম কেদারনাথ, উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তো কত মানুষ মারা গিয়েছেন। তাতে কি প্রধানমন্ত্রী সব বন্ধ করে ঘরে বসে আছেন?’’
কার্নিভালের আয়োজন, গাড়ি রাখা ইত্যাদি নানা কারণ দেখিয়ে পুলিশ অবশ্য মাতঙ্গিনী হাজরা মূর্তির নীচে অবস্থানরত চাকরি-প্রার্থীদের আপাতত উঠে যেতে বলেছে। যার প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ‘‘মমতা সরকারের পুলিশ বঞ্চিত, মেধাযুক্ত প্রার্থীদের অবস্থানের উপরে অনৈতিক ভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে। কলকাতা হাই কোর্টের অনুমতি নিয়ে তাঁরা বসেছিলেন। তাঁদের ন্যায্য প্রতিবাদ ওখানে চলতে থাকলে কার্নিভালে দাগ লেগে যাবে বলে মনে করছে রাজ্য সরকার!’’ মন্ত্রী ফিরহাদ আবার পাল্টা বলেছেন, ‘‘আন্দোলনের অধিকার নিশ্চিত ভাবে আছে। দেশ-বিদেশের মানুষ আসবেন। কার্নিভালের সেই গুরুত্ব মেনে তাঁরা একটা দিন সরে গেলে তাঁদের কোনও ক্ষতি হবে না। তাঁদের সমস্যার সমাধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই করবেন। তাই তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে লোক ক্ষেপানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, খুব সুবিধা করতে পারবে না!’’
চাকরি-প্রার্থীরা অবশ্য কার্নিভালের জন্য সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, রাস্তায় বসে থাকার জন্য তাঁরা আসেননি। নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হলে এক বারেই তাঁরা উঠে যেতেন।