শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে যাওয়ার সময় ইডি আধিকারিকদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রাজ্য সরকার তথা শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের উপরে চাপ বাড়াল বিজেপি। এক দিকে যেমন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন, তেমনই ঘটনার দায় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আদালতের নির্দেশে কাজ করতে যাওয়া তদন্তকারীদের কেন হামলার মুখে পড়তে হবে, সেই প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছে বাম-কংগ্রেসও। পাল্টা তৃণমূলের অবশ্য প্রশ্ন, মণিপুরের ঘটনার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেন পদত্যাগ করবেন না?
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী শুক্রবার ঘটনার পরেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বিষয়টি জানিয়েছেন এবং সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজ্যপালকে পরিস্থিতি পর্যালোচনার আবেদন করেছেন। পরে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা ও নদিয়ার বেথুয়াডহরিতে দু’টি কর্মসূচিতে গিয়ে শুভেন্দু এই ঘটনা নিয়ে তৃণমূলকে নিশানা করেছেন। শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগির ও শেখ সিরাজউদ্দিন এবং সরবেড়িয়া-আগারহাটি পঞ্চায়েতের প্রধান জিয়াউদ্দিনের ছবি দেখিয়ে হামলার ঘটনায় তাঁদের জড়িত থাকার দাবি করেছেন শুভেন্দু। ঘটনায় রোহিঙ্গাদের যোগ আছে বলেও তাঁর অভিযোগ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এর পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত আছে। চোরেদের বাঁচানোর জন্য রাজ্য পুলিশের একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপো এগুলো করছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলরাজ চলছে।” বিরোধী দলনেতার দাবি, ‘‘প্রাণ সংশয়ের মুখেও সিআরপিএফ জওয়ানেরা সংযত ছিলেন। এই সাহসী জওয়ানেরাই মুখ্যমন্ত্রী ধূর্ত চাল বানচাল করে দিয়েছেন! ওখানে জনতার উপরে গুলি চললে শীতলখুচির মতো ঘটনা হত, এক জনেরও প্রাণহানি হলে মমতা দুর্নীতি ও তদন্ত থেকে নজর ঘুরিয়ে রাজনীতি করতে নেমে পড়তেন।’’
শুভেন্দুর আরও অভিযোগ, ‘‘শাহজাহান আগে সিপিএমে ছিল, পরে তৃণমূলে আসে। এখন সে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মৎস্য ও প্রাণী সম্পদের কর্মাধ্যক্ষ, জেলে থাকা মন্ত্রী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পদ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে সুসম্পর্ক যুক্ত, ভাইপোর সঙ্গে যার নিভৃতে আলোচনা হয়, তার নিরাপত্তা দিয়েছে রাজ্য সরকার। চোর মমতার প্রিয় পাত্র শাহজাহান শেখ!”
দিল্লিতে এ দিনই বিজেপির মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া দাবি করেছেন, ‘‘সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই তাঁর উচিত সবার আগে ইস্তফা দেওয়া।’’ পাশাপাশি বাংলার অরাজক পরিস্থিতি নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি। গৌরব বলেন, ‘‘রাজ্যের পরিস্থিতি এমন যে, ইডি আধিকারিকেরা পুলিশের হস্তক্ষেপ চাইলে স্থানীয় পুলিশ সাহায্য করা তো দূরে থাক, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে মানা করে দেয়। রাজ্যে আইনের শাসন বলে কিছু নেই। তৃণমূলের অপরাধীরা যদি মনে করে, এ ভাবে তাঁরা বেচে যাবে, তা হলে তারা ভুল ভাবছে। মুখ্যমন্ত্রী যখন আইনের পরিবর্তে দুষ্কৃতীদের পাশে দাঁড়ান, তখন এ কথা বলা ভুল হবে না যে, তিনি কেবল ক্ষমতার সুখ ভোগ করতেই কুর্সিতে বসে রয়েছেন।’’ তবে এমন ঘটনার পরে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার জন্য কেন্দ্রের কাছে বিজেপি দরবার করবে কি না, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনও মন্তব্য করতে চাননি গৌরব। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা দেবেন, এটাই আমাদের আশা। কেন্দ্রের সরকার কোনও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হলে আইনের পরিধির মধ্যে থেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হবে।’’ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিও করেছেন গৌরব।
সন্দেশখালির ঘটনার এনআইএ তদন্তের দাবি করে এ দিনই শাহকে চিঠি দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। কোচবিহারে এ দিন সুকান্তের অভিযোগ, “তৃণমূল হার্মাদ, জেহাদিদের হাতে রাজ্যটা ছেড়ে দিচ্ছে।”
রাজ্যের মন্ত্রী ও তৃণমূলের নেত্রী শশী পাঁজার তোপ, “আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাইছেন আর গোটা দেশ আজ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছে। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে গিয়েছিলেন? কোনও পদক্ষেপ করেছিলেন? সংসদে হামলার পরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ কার উচিত ছিল।” তাঁর সংযোজন, “বিজেপিকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, তৃণমূল সরকার গণতান্ত্রিক ভাবে তৃতীয় বারের নির্বাচিত সরকার। কেন্দ্র বারবার চেষ্টা করেছে যাতে রাজ্য সরকার কাজ করতে না পারে।’’ তাঁর প্রশ্ন, “এক বিজেপি নেতা ৩০ ডিসেম্বর বলেছিলেন, অপেক্ষা করুন। সন্দেশখালিতে একটা কিছু ঘটবে। তার পরে আজ সেখানে কী ঘটল? এটা কাকতালীয় না ষড়যন্ত্র?’’
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের অভিযোগ, ‘‘রাজ্যে ২০১১’র নির্বাচনের পর থেকেই অপরাধীদের বুকের পাটা বেড়েছে। তারা মনে করছে, এই সরকার তাদের। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখনই বলেছিলেন। গত ১২ বছর ধরে আমরা বামপন্থীরা বলছি। সন্দেশখালির মতো রাজ্যের বিভিন্ন এলাকাকে মুক্তাঞ্চল করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে।’’ যে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় শুভেন্দু এ দিন বক্তৃতা করেছেন, সেই জেলায় তৃণমূলে থাকার সময়ে তিনি বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত করার জন্য আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, এমন বাহিনী গড়িয়েছিলেন বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন সেলিম। সেই সঙ্গেই বিরোধী দলনেতাকে তাঁর চ্যালেঞ্জ, ‘‘২০১১ সালের আগে শাহজাহানের নাম কবে কোন ঘটনায় এসেছে, দেখা হোক!’’
সরব হয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও। বহরমপুরে তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাংলার তৃণমূলের নখ-দাঁত ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। আইনি মোকাবিলা করার ক্ষমতা যাদের থাকে না, যারা দুর্বল, যারা জানে যে তারা অপরাধী, তারা অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য হিংসার আশ্রয় নিয়ে থাকে। বাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলে যে কিছু নেই, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তা আরও এক বার প্রমাণিত হল।’’ পাশাপাশিই, ‘সেভ ডেমোক্র্যাসি’র রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক চঞ্চল চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘বাংলায় আইনের শাসনের অবশিষ্টটুকুও আর থাকল না! এটা স্থানীয় স্তরের ব্যাপার নয়। উচ্চতর নেতৃত্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী সংযত আচরণ না করলে এই ঘটনা যে আকার ধারণ করতো, শাসক দল তার ফায়দা তোলার কাজে নেমে পড়তো।’’
ইডি আধিকারিকদের উপরে আক্রমণের ঘটনায় কড়া পদক্ষেপের জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহকে চিঠি লিখেছেন সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীও। ওই চিঠিতে দিব্যেন্দু লিখেছেন, দুর্নীতি দমনে তদন্তে গিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তসংস্থার অফিসারেরা যে ভাবে আক্রমণের মুখে পড়েছেন, তাতে প্রমাণ হয় রাজ্যে আইনের শাসন নেই। এই পরিস্থিতিকে ‘জঙ্গল-রাজ’ হিসেবে উল্লেখ করে দুর্নীতি এবং তা আড়াল করতে রাজ্য প্রশাসনের যোগাযোগের অভিযোগও করেছেন তমলুকের সাংসদ। প্রসঙ্গত, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতীকে তমলুক লোকসভা আসন থেকে নির্বাচিত দিব্যেন্দুর সঙ্গে দলের দূরত্ব বাড়ছে বহু দিন ধরেই। এই চিঠির শেষে ‘ভারত মাতা কি জয়’ লিখেও বিশেষ বার্তা দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু।