ফাইল চিত্র।
তৃতীয় বার সরকার গড়ে শিল্পায়নের পথে আপসহীন ভাবে ঝাঁপানোর বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি ষষ্ঠ বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের (বিজিবিএস) মঞ্চ থেকে সে কথা মনে করিয়ে তাঁর দাবি, প্রথম ১০ বছরে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে। আগামী ১০ বছরে রাজ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। এ জন্য হাতিয়ার হবে শিল্পায়ন। সেই লক্ষ্যে গত এক বছরে বহু পদক্ষেপও করেছে প্রশাসন। তবে বিরোধীদের কটাক্ষ, সবই কার্যত কাগুজে পরিসংখ্যান। বাস্তবে রাজ্যে শিল্পের ছবি মলিনই। বামেদের দাবি, যেটুকু লগ্নি এসেছে, সেটা তাদের আমলে তৈরি ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, বাংলায় বড় শিল্প টানার ক্ষেত্রে অন্যতম কাঁটা একলপ্তে বড় জমির অভাব। মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, করোনাকালে যখন দেশে জিডিপি কমেছে, তখন বৃদ্ধির মুখ দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। ল্যান্ড ব্যাঙ্কে জমি আছে। তার উপরে সহজে ব্যবসার সুবিধা দেওয়ায় লগ্নি হয়েছে বড়-ছোট-মাঝারি, সব রকম শিল্পে। রাজারহাটে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারের পাশাপাশি সায়েন্স সিটির কাছে মাথা তুলেছে বিশ্ব বাংলা মেলা প্রাঙ্গণের মতো আধুনিক পরিকাঠামো। তাঁর বার্তা, গত পাঁচটি বিজিবিএসে অর্জিত প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকার লগ্নি-প্রস্তাব বাস্তবায়িত হচ্ছে। সলতে পাকানো শুরু হয়েছে এ বারের প্রস্তাবগুলির।
তবু তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার এক বছর গড়ানোর পরে রাজ্যবাসীর প্রশ্ন, শিল্পের জমিতে সত্যিই ফলন হল কি? নাকি জমি তৈরিতেই খামতি
রয়ে গেল?
আইআইএম-কলকাতার অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অনুপ সিন্হার মতে, এ রাজ্য মূলত কৃষি এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের উপরে নির্ভরশীল। শিল্পায়নের চেষ্টা চলছে হয়তো। তবে তেমন এগোয়নি। বড় লগ্নি কার্যত অধরা। তা টানার সহায়ক শিল্প নীতিও অস্পষ্ট। বিরোধীদের অভিযোগ, উল্টে বহু গুণ বেড়েছে তোলাবাজি-সিন্ডিকেটের মতো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা।
জমি, আইনশৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক ঝুঁকির জল মেপে তবেই সাধারণত পুঁজি ঢালতে আসেন লগ্নিকারীরা। আর এই বিষয়গুলি গড়ে দেয় একটি রাজ্যের ভাবমূর্তি। অনুপবাবুর মতে, আর্থিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়া আন্দোলনের জেরে ভাবমূর্তি মার খেয়েছিল বাম জমানায়। পরবর্তীকালে সিঙ্গুরের মতো আন্দোলন তাতে ফের আঘাত করেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশও একমত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন মমতাকে জিতিয়ে এনেছে ঠিকই, কিন্তু একটা নাছোড় শিল্প-বিরোধী ভাবমূর্তি গেঁথে দিয়েছে শাসকদলের গায়েও। যা পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি। ফলে বড়-ছোট, বহু লগ্নির সিদ্ধান্ত দিনের আলো দেখছে না। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ভিন্ রাজ্যের লগ্নিকারীদের একাংশ সংশয়ী বলেই পুঁজির বিকাশ কম, দাবি অনুপবাবুর।
রাজ্যের অবশ্য বার্তা, বাংলা ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পে (এমএসএমই) লগ্নির অন্যতম ঠিকানা। এ বার নিশানা মূলত বড় শিল্প। শিল্পায়নে গতি আনতে ও পরিকাঠামো উন্নয়নে শিল্প-প্রশাসন সমন্বয় সমেত নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। আরও সহজ করা হচ্ছে বিনিয়োগ-ব্যবসার পরিবেশ। সম্প্রতি বিজিবিএসে স্থিরতা, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছ প্রশাসনের বার্তা দিয়ে মমতার দাবি, সামাজিক বিভাজনের পরিবর্তে সকলকে নিয়ে চলবে বাংলা।
কিন্তু আদতে চিঁড়ে কতটা ভিজছে? বিভিন্ন জেলার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। যেমন, গত এক বছরে পূর্ব মেদিনীপুরে একমাত্র হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে নতুন লগ্নি হয়েছে। আইওসি-র কারখানা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বন্ধ ‘মডার্ন কনকাস্ট’ খুলতে এগিয়েছে বেসরকারি সংস্থা। তবে জেলার একাংশে কারখানায় কর্মী নিয়োগ ঘিরে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ উঠেছে। জেলাশাসক পূর্ণেন্দু মাজির দাবি, এক বছরে হলদিয়ায় লগ্নি এসেছে অনেক।
সম্ভাবনা থাকলেও পশ্চিম মেদিনীপুরে শিল্প থমকে। গোয়ালতোড়ের শিল্পতালুকে শিল্প হয়নি। শুধু সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে জার্মান লগ্নি আসা নিয়ে চর্চা বহাল। শালবনিতে ইস্পাতের বদলে হয়েছে সিমেন্ট কারখানা। তবে জেলায় ছোট শিল্প ও ঝাড়গ্রামে পর্যটন ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। হতাশ হাওড়াবাসীরাও। রানিহাটির ফাউন্ড্রি পার্ক, ডোমজুড়ের রাবার পার্ক এবং জুয়েলারি হাব চালু হয়নি। ফুলেশ্বরের কানোরিয়া জুটমিলে এখনও তালা।
হুগলি জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, গত অর্থবর্ষে কিছু এমএসএমই-র রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। বন্ধ হিন্দমোটর কারখানার ১০০ একর জমিতে মুম্বইয়ের বড় সংস্থা ওয়্যারহাউস এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের হাব করতে উৎসাহী। তবে শিল্পে নতুন খবর নেই দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। বরং অভিযোগ, ধুঁকতে থাকা ফলতার এসইজ়েড-এ আরও কারখানা বন্ধ হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার ছবিটা ভাল। হাবড়ার বাণীপুরে টেক্সটাইল হাব এবং অশোকনগরে বন্ধ থাকা কল্যাণী স্পিনিং মিলে টেক্সটাইল ও পাওয়ালুম তৈরির কাজ হচ্ছে। খুলছে জুয়েলারি হাব।
পশ্চিম বর্ধমান জেলা শিল্পকেন্দ্রের দাবি, গত দু’টি অর্থবর্ষে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা লগ্নি এসেছে। এক-দু’বছরে আসতে পারে ৪০০০ কোটিরও বেশি। বাঁকুড়া ও পূর্ব বর্ধমান জেলা প্রশাসনের দাবি, লগ্নি এসেছে যথাক্রমে ১০.৮৭ কোটি ও ৪৯৪১ কোটি টাকার। এমএসএমই-তে পুরুলিয়া এক বছরে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ পাওয়ার দাবি করেছে।
উত্তরবঙ্গে আলিপুরদুয়ার জেলায় তেলের মিল ও পিএমইজিপি প্রকল্পে ছোট প্রায় ৫০টি কারখানা হয়েছে। কোচবিহারের দশটি জায়গায় চট, প্লাস্টিক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বস্ত্র-সহ একগুচ্ছ এমএসএমই তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৫টি এমএসএমই-র কারখানা হয়েছে মালদহে। জলপাইগুড়ি লগ্নি পেয়েছে ১৪০ কোটি টাকা। অন্তত ৩২টি সংস্থা এসেছে। তবে বন্ধ হয়েছে এমএসএমই-র ১৬টি ইউনিট-ও। উত্তর দিনাজপুর জেলায় এক বছরে নতুন শিল্প হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে লগ্নির অভিমুখ প্রসঙ্গে নতুন চর্চা মায়াপুরে ৭০০ একর জমিতে মন্দির গড়ার সুযোগ মেলায় বিজিবিএসে শিল্পপতি সজ্জন জিন্দলের মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদজ্ঞাপন। প্রায় এক যুগ আগে শালবনীতে ইস্পাত কারখানা তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন যিনি।
(চলবে)