আইটিআই প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কিনারা তারা করতে পারেনি দু’মাসেও। সেই রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ অর্থাৎ সিআইডি-কেই দেওয়া হল টেট-এর প্রশ্নপত্র লোপাটের তদন্তভার। ওই পরীক্ষা-বিভ্রাটে বিরোধী শিবির চক্রান্তের গন্ধ পেয়েছে আগেই। এ বার তাদের অভিযোগ, প্রশ্নপত্র গায়েবের পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই তদন্তের জন্য আবার ডাকা হয়েছে সিআইডি-কে।
প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট হওয়ার কথা ছিল রবিবার। পরীক্ষার্থী প্রায় ২৩ লক্ষ। প্রশ্নপত্রের একটি প্যাকেট উধাও হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা পিছিয়ে যায়য়। কিন্তু পরিবর্তিত তারিখ ৪ অক্টোবরেও সেই পরীক্ষা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আজ, সোমবার নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে ঠিক হবে, ওই দিন টেট হবে কি না।
নবান্ন সূত্রের খবর, কোথায় প্রশ্নপত্র লোপাটের ঘটনা ঘটেছিল এবং এর পিছনে কারা, তা জানতেই সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনায় দু’জন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী এবং দু’জন রাজ্য পুলিশকর্মীর নাম জড়িয়েছে। ওই চার জনের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছে রাজ্যের শিক্ষা দফতর। কিন্তু তাঁদের কাউকেই এখনও হেফাজতে নেয়নি পুলিশ। কেন তাঁদের পুলিশের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না, সেই প্রশ্ন উঠেছে সিআইডি-তেও।
প্রশ্নটা বিরোধীদেরও। তাদের অভিযোগ, আইআইটি প্রবেশিকার প্রশ্ন ফাঁসের প্রাথমিক তদন্তে তৃণমূলের লোকজনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরেই সিআইডি আর এগোয়নি। এখন টেট-বিভ্রাট ঘুলিয়ে দিতেই সিআইডি-কে ডাকা হল। হাইকোর্টের কোনও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে ওই তদন্ত করানোর দাবি তুলেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁর কথায়, ‘‘টেটের প্রশ্ন ফাঁস নিছক দুর্ঘটনা নয়। শাসক দল এর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে তৃণমূল টাকা নয়ছয় করছে। বিভাগীয় তদন্তে পূর্ণ সত্য বেরোবে না।’’
বিমানবাবুর দাবি, বাসে প্রশ্নপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় ডাক বিভাগের যে-দুই কর্মী (অরূপ দাস ও অরূপ মুখোপাধ্যায়) সঙ্গে ছিলেন এবং যাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে, তাঁরা তৃণমূলের সংগঠন করেন। তাঁরা তৃণমূলের দুই সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ অনুগামী’ বলেও বিমানবাবুর অভিযোগ। যদিও কল্যাণবাবু বলেছেন, ‘‘বিমানবাবুর বাজে কথার জবাব দেওয়ার মানে হয় না! তা ছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে আমার কোনও অনুগামীই নেই। অনুগামী যা আছে, তা দলের।’’
বিমানবাবুর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন অভিষেকবাবুও। তিনি বলেন, ‘‘আমি এই ঘটনা বা ওই দুই অভিযুক্তের সঙ্গে কোনও ভাবেই জড়িত নই। উনি (বিমানবাবু) যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেন, তা হলে আমাকে প্রকাশ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। তা না-হলে নিজের মন্তব্য ফিরিয়ে নিয়ে ওঁকে প্রকাশ্যে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে।’’ বিমানবাবুর মন্তব্য খতিয়ে দেখে তাঁরা যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলেও জানিয়ে দেন অভিষেকবাবু।
বিরোধীদের অভিযোগ অমূলক বলে মন্তব্য করে সিআইডি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘সবে তদন্ত শুরু হয়েছে। এখনই তদন্তের ব্যাপারে নেতিবাচক সমালোচনা করা উচিত নয়।’’ সিআইডি সূত্রের খবর, যে-বাস থেকে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট পড়ে গিয়েছিল, শনিবার তদন্তভার নিয়েই ওই রাতে এবং রবিবার সকালেই তার চালককে নিয়ে গোয়েন্দারা রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। যেখানে যেখানে প্যাকেট পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সেই সব জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়। দীর্ঘ ক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাসচালককে। এক সিআইডি-কর্তা বলেন, ‘‘প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের যাঁরা বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সকলকেই ঠিক সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’’
রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ আমলা জানান, সিআইডি-র উপরে তাঁদের পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু তদন্তভার পেয়ে কী করছে সিআইডি?
ভবানী ভবনের খবর, গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট বাসের চালক স্বপন বসুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। শনিবার রাতে প্রথমে তাঁরা বাসের মালিক শিবশঙ্কর রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাসটিকে নিয়ে যান পেয়ারাপাড়া ফাঁড়িতে। রাতেই চালককে নিয়ে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখেন। সিআইডি-র খবর, মালিক তাদের জানান, ১৫ জুলাই তাঁর বাসের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেওয়া হয়। বাসের পিছনের কাচ ঠিক ছিল এবং সেটি রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো ছিল। সিআইডি গ্যারাজ থেকে রাবার ব্যান্ডটিও বাজেয়াপ্ত করেছে।
বৃহস্পতিবার সকালে দু’টি বাস প্রশ্নপত্র নিয়ে গন্তব্যে রওনা হয়। তার মধ্যে শিবশঙ্করবাবুর বাসটিও ছিল। গোয়েন্দাদের দাবি, বাসচালক তাঁদের জানান, বাসের পিছনে সিলিং পর্যন্ত প্রশ্নপত্রের ১৫৪টি প্যাকেট রাখেন দুই ডাককর্মী। চালক-খালাসি আপত্তি করা সত্ত্বেও তাতে কান দেওয়া হয়নি। গোয়েন্দাদের অনুমান, প্রশ্নপত্র লোপাটের ঘটনাটি ঘটেছে নিবেদিতা সেতুর পরে কোনও জায়গায়।
এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘প্রশ্নপত্রের প্যাকেট বাসের আসনের উপরে না-রেখে একদম পিছনে রাখা হল কেন, সেটা বড় প্রশ্ন। জবাব পেতে বাসে উপস্থিত সকলকেই একসঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।’’
সিআইডি তদন্তে নামায় পরীক্ষার্থীরা অবশ্য আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বরং তাঁদের উৎকণ্ঠা-বিভ্রান্তি বাড়ছে। শুক্রবার পরীক্ষার নতুন দিন (৪ অক্টোবর) ঘোষণা করেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তার পরেও প্রার্থীদের বিভ্রান্তি কাটেনি। পার্থবাবু যখন পরীক্ষার পরিবর্তিত দিন ঘোষণা করছিলেন, তখন শিক্ষা দফতর খেয়ালই করেনি যে, ৩ অক্টোবর সল্টলেক-নিউ টাউন ও আসানসোল পুর নিগম এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচন রয়েছে। পরীক্ষার নতুন দিন ঘোষণার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র দফতরের সঙ্গেও আলোচনা করা হয়নি। তা ছাড়া ৪ অক্টোবর প্রতিযোগিতামূলক আরও ১০টি পরীক্ষা রয়েছে। এ-সব নিয়ে জটিলতা কাটাতে সোমবার নবান্নে স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে থাকতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট সব দফতরের আধিকরিকদের। সেখানেই টেটের নতুন দিন চূড়ান্ত হওয়ার কথা। অর্থাৎ শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ৪ অক্টোবর পরীক্ষা নেওয়া হবে কি না, তা জানা যাবে আজ।
পরীক্ষার পরিবর্তিত তারিখ (৪ অক্টোবর) বাতিল করা হবে, এমন কথা নবান্নের কোনও শীর্ষ আমলাই জোর দিয়ে বলছেন না। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ আমলার কথায়, ‘‘পুরভোটের পরের দিন পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে বাস্তব কিছু অসুবিধে আছে। আবার ৪ অক্টোবরের পরেই দুর্গাপুজো এসে যাবে। সে-ক্ষেত্রে পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে হবে কালীপুজোর পর পর্যন্ত। তাতেও সমস্যা রয়েছে। সব দিক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’’