প্রত্যাশার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব। নিজস্ব চিত্র
পরীক্ষা দেওয়া ও কৃতকার্য হওয়া ঠিক কতটা জরুরি? কতটা জরুরি বাবা-মায়ের কাছে মার না খেয়ে আরও বেশ কিছুদিন মজায় মজায় বিলাসে দিন কাটিয়ে যাওয়া? এ প্রশ্ন সবাই করছি। প্রশ্ন করছি আর ভেসে উঠছে একটা ক্লাস টু-এর হাসি হাসি মুখ। সে মুখের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যাচ্ছে আমার সন্তানের মুখ। বুকটা ধড়াস করে উঠছে। মনে হচ্ছে, আমার ছেলে স্কুলে যাচ্ছে, সেকেন্ড বা থার্ড পিরিয়ড। টয়লেট যাচ্ছে— কিন্তু ফিরছে না। আমি বাড়িতে চিকেন রাঁধছি, ও ফিরে এসে খাবে বলে। কিন্তু, ও স্কুলের পর বাড়ি ফিরছে না। আমার রাঁধা ভাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, আমার সোনামণির প্রিয় চিকেন কারি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে —ও ফিরবে না, কোনও দিন না।
কোটি কোটি মানুষের দেশে কোন সে আইন, যা পাশ করালে এই সব অপরাধ বন্ধ হবে? কোন সে পুলিশ থানা, যেখানে আইন রক্ষকেরা রে রে করে তেড়ে যাবে অপরাধ ঘটার প্রাক মুহূর্তে? কোন সে শক্তি, যা অপরাধীর হাত অবশ করে হাত থেকে ফেলে দেবে ছুরি? পারবে কি? উত্তর হল, না পারবে না। কোনও আইন, আদালত, প্রশাসন বা পুলিশ বন্ধ করাতে পারবে না এই সব অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় ঘটানো, ক্রমাগত বেড়ে চলা জঘন্য অপরাধগুলো। অপরাধ ঘটে যাওয়ার পরে অপরাধীর শাস্তি প্রদানের মতো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর প্রচেষ্টা চলছে বহুদিন ধরে। আর চলবেও আরও বহুদিন।
কারণ, আমরা ভাবছি না, আমাদের গোড়ায় গলদ। উই ধরা কাঠের উপরে চকচকে রং করে দিব্যি ভাবছি, এই তো কী সুন্দর সব নতুনের মতো। সব্বাই দৌড়াচ্ছি কী এক অদ্ভুত স্বপ্নকে পূর্ণ করতে। সেখানে ‘আমরা’ কথাটার দৈর্ঘ্য খাটো হতে হতে ‘আমি’তে এসে ঠেকেছে। সাথী, সন্তান, সমাজ সব কিছু আজ শুধু নিজের স্বার্থে, নিজের ইচ্ছে পূরণের স্বার্থে। সেখানে বাবা-মায়ের যেমন সন্তানের মনের খবর নেওয়ার দায় নেই, দায় নেই তার নিজের ইচ্ছে কী, তা জানার, সন্তানেরও ভাল মানুষ হয়ে ওঠার দায় নেই। একটাই বেদ বাক্য, ‘যে ভাবেই হোক দৌড়ে তোমায় এগিয়ে থাকতেই হবে’। প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতে সবার শুধু একটাই লক্ষ্য, ‘তোমাকে টিকে থাকতে হবে এই লড়াইয়ে— যে কোনও মূল্যে। এই প্রতিযোগিতা তোমার নিজের বর্তমানের সঙ্গে নিজের আগামীর নয় বরং তোমার পাশের বাচ্চাটার সঙ্গে তোমার। তোমার মামাতো, পিসতুতো, খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো ভাইয়ের সঙ্গে তোমার।’
তাই শিশুর জন্মের আগে থেকেই বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজনদের এক অজানা আশঙ্কা, আমরা না থাকলে ওর কী করে চলবে? কী রোজগার করবে? গাড়ি বাড়ি হবে তো? স্টেটাস পড়ে যাবে না তো? পিসতুতো দাদা ফিলাডেলফিয়ায় আছে, আমাদেরটা ঠিক হার্ভার্ড যাবে তো? বা নিদেনপক্ষে আইআইটি! অথবা ডাক্তার হলে ঠিক আছে, অথবা ল’ পড়ো, ওটারও এখন ‘প্রসপেক্ট’ আছে।
প্রসপেক্ট কী? খায় না মাথায় দেয়? না, আসলে যাতে ভাল আয় আছে, সেটাই ‘প্রসপেক্টিভ’ পেশা। অতএব ছেলেকে ওইটাই হতে হবে। আমরা তাই ভাল ভাল স্কুলে ভর্তি করতে ছুটছি। যেন জ্বর হয়েছে আর স্কুল হল অ্যান্টিবায়োটিক। ভর্তি করে দিলেই হল তথাকথিত কোনও এক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। আমাদের দায়িত্ব শেষ। মাসে পঁচিশ হাজার দিতে হোক না স্কুলে, কাল ওটাই পঁচিশ লাখের প্যাকেজ এনে দেবে।
এই স্কুল কেন? না, ওখানে সব ডিজিটাল। সব সুবিধা আছে। সব অত্যাধুনিক ব্যবস্থা। বাচ্চারা চকচকে আর সুন্দর হয়ে বের হয় এখান থেকে। এবং ঠিক সে কারণেই সব ফেসিলিটি দিচ্ছি সন্তানকে, সুতরাং সে পারছে না, এটা শুনতে নারাজ বাবা-মা। আর এই চাপে সন্তান যে জীবন পাচ্ছে, তা বৈভবে মোড়া (ঘুষ) এক জেলখানা, যেখানে সব কিছু আছে। শুধু নিজের ‘ইচ্ছের’ কোনও স্থান নেই। এ এক জটিল আবর্ত, যার শুরু কোথায় বোঝা মুশকিল, বোঝা মুশকিল, এর শেষ কোথায়। চাহিদা আর বাস্তবের মিল না থাকায় এক অপূর্ণতা গ্রাস করছে আমাদের। আর না পাওয়াকে পাওয়া বানানোর এক আদিম অন্যায় জেদ চেপে বসছে।
পুরো ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে এক বিশেষ থিমের উপরে, যেখানে আর্থিক উন্নতিই প্রকৃত আর একমাত্র উন্নতি। তাই যেখানে টাকা আছে সেই দিকে যাও। তাই যে ছেলে সচিন হতে পারত, সে হয়ে উঠছে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, যে হতে পারত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সে হয়ে উঠছে মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, যে হতে পারতো ভ্যান গখ, সে হয়ে উঠছে মদের দোকানদার। গাছ যেমন সঠিক পরিচর্যা না পেলে ছোট ছোট ফুল দেয়, পোকা ধরা ফল দেয় অথবা শুকিয়ে যায়, এই শিশুরাও খোলা মাঠ, খোলা আকাশ, মায়া, মমতা, সমবেদনা আর ‘প্রকৃত মানুষ হও’ এই শিক্ষা না পেয়ে অর্থাৎ মানুষ গড়ার উপকরণ না পেয়ে হয়ে উঠছে অমানুষ। তাই, ছুটি পাওয়ার লক্ষ্যে সে ছুরি নিয়ে যাকে পারছে, তার নলি কেটে ফেলে রেখে যাচ্ছে টয়লেটে।
আজ খবরের কাগজে একটা ছেলে মারা যাওয়ার কথা ছাপা হলেও আসলে কিন্তু শুধু ক্লাস টু-এর ছেলেটিই মারা যায়নি। ‘মারা’ গিয়েছে ক্লাস ইলেভেনের ছেলেটিও, যে কিনা ক্লাস টু-এর ছাত্র খুনে অভিযুক্ত! সন্তান হারিয়েছে দু-দু’টো পরিবার, শেষ হয়ে গিয়েছে দু-দু’টো স্বপ্ন। আর, আমরা গভীরে না গিয়ে খবরের কাগজের পাতায় ভয়াবহ খবর পড়া শেষ হলেই পাতা উল্টে চলে যাচ্ছি সিনেমার খবরে। কাগজ পড়া শেষ হলেই দৌড়ে চলে যাচ্ছি স্নানের ঘর, দশ মিনিটে রেডি হয়ে সন্তানের হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ির সিটে, স্কুলে নামিয়ে ‘বাই’ বলে একটু থেমে বলে দিচ্ছি , ‘একা একা টয়লেট যেও না ’, যেন সমস্ত বিপদ এখন টয়লেটে, তার বাইরের পৃথিবীটা জঞ্জালমুক্ত!
লেখিকা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দপ্তরের যুগ্ম অধিকর্তা