পাঁচড়া গ্রামে তৃণমূলের পার্টি অফিসের বাইরে আসবাবে আগুন দিয়েছে উত্তেজিত গ্রামবাসী। নিজস্ব চিত্র
হামলা ও পাল্টা হামলায় রক্ত ঝরল বীরভূমে। রাতের অন্ধকারে খয়রাশোল ব্লকের মুক্তিনগর ও পাঁচড়া গ্রামে হামলা চালাতে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়ল দুষ্কৃতীরা। হামলাকারীদের এক জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল গ্রামেই। তার পরে তৃণমূল নেতার বাড়িতে ভাঙচুর চলল, তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে আগুন লাগাল উত্তেজিত জনতা। পুড়িয়ে দেওয়া হল একাধিক মোটরবাইক।
ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই যে অশান্তি চলছিল বীরভূমের নানা প্রান্তে, তা চরম আকার নিল শুক্রবার রাতে। যা অনেককে মনে করিয়ে দিয়েছে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পরে এই জেলারই পাড়ুইয়ের কথা। তখনও
বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে এলাকা দখলের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ যায় অনেকের। পাড়ুইয়ের মতোই এ ক্ষেত্রেও হামলার অভিযোগ তৃণমূলের দিকে, প্রতিরোধে অভিযুক্ত বিজেপি।
জেলা পুলিশ সুপার নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী জানান, কান্ত বাউড়ি (৩৮) নামে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। বাড়ি স্থানীয় ঢেড়োবাজার গ্রামে। পাঁচ জন জখম। তাঁদের মধ্যে এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এলাকায় পুলিশ পিকেট বসেছে। দু’পক্ষের বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘যে পক্ষ রাতে ওই গ্রামে গিয়েছিল, তারা কোনও সাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ওখানে যায়নি। আবার যে ভাবে তাদের মারধর করা হয়েছে, সেটাও আইন হাতে তুলে নেওয়ার শামিল। কোনওটাকেই বরদাস্ত
করা হবে না। দু’পক্ষকে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে। আইনানুগ পদক্ষেপ করা হবে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার রাত পৌনে দশটা নাগাদ হিংলো ও অজয় নদের মধ্যবর্তী গ্রাম মুক্তিনগর থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত। শনিবার সকালে তার আঁচ এসে পড়ে পাঁচড়া গ্রামে। খয়রাশোল ব্লক দুবরাজপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এ বার বীরভূমে ১১টি আসনের মধ্যে একমাত্র দুবরাজপুরেই জয়ী হয়েছে বিজেপি। বাকি সব তৃণমূলের দখলে। মুক্তিনগর ও পাঁচড়ায় বিজেপির ভাল প্রভাব রয়েছে। তাদের অভিযোগ, রাতে বোমা-বন্দুক নিয়ে ‘সন্ত্রাস’ চালাতে আসে তৃণমূল আশ্রিত শ’দেড়েক দুষ্কৃতী। কিন্তু, গ্রামবাসীরা তৈরি ছিলেন। তাঁদের হাতে মোটরবাইক সমেত ধরা পড়ে যান কান্ত। শুরু হয় গণপিটুনি। ঘটনাস্থলেই কান্ত মারা যান। গ্রামের একাধিক বাসিন্দার দাবি, ‘‘ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই খয়রাশোলের বহু গ্রামে হামলা চালাচ্ছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা। মার খেতে খেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় প্রত্যাঘাত করতে বাধ্য হয়েছি।’’ দুবরাজপুরের বিজেপি বিধায়ক অনুপ সাহার দাবি, ‘‘প্রাণ, সম্পত্তি ও মহিলাদের সম্মানহানি রুখতেই প্রতিরোধ হয়েছে।’’
এখানেই ঘটনা শেষ নয়। অভিযোগ, মুক্তিনগরে মার খেয়ে নদী পেরিয়ে গণেশ বাউড়ি নামে এক তৃণমূল কর্মী পাঁচড়া গ্রামে পৌঁছে ফের ধরা পড়ে যান। রাতভর তাঁকে আটকে রাখা হয়। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, গণেশের মুখ থেকে হামলার পিছনে স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতার নাম জানা যায়। শনিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ কয়েকশো পুরুষ-মহিলা প্রথমে পাঁচড়ার তৃণমূল কার্যালয়ে হামলা চালান। পতাকা, ফেস্টুন, আসবাব বার করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে খয়রাশোলের পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ রজত (মাখন) মুখোপাধ্যায়, ১০০ দিনের কাজের সচিব কৃপাময় মুখোপাধ্যায়, তাঁর দাদা সুখময় এবং বুথ সভাপতি পরিমল কর্মকারের বাড়িতেও চড়াও হয় উত্তেজিত ভিড়। কোনও ক্রমে তাঁরা পালিয়ে বাঁচলেও বাড়ি জুড়ে কার্যত তাণ্ডব চালানো হয়েছে।
তৃণমূল অবশ্য হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দুবরাজপুরে বিজেপি জেতার পর থেকেই ওরা অত্যাচার চালাচ্ছে। শুক্রবার আমাদের বেশ কিছু কর্মীর সঙ্গে প্রথমে এই নিয়ে বচসা হয়। তার পর মিলিত আক্রমণ হয়েছে আমাদের দলের কর্মীদের উপর।’’ অন্য দিকে, খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা কাঞ্চন অধিকারীর দাবি, ‘‘মুক্তিনগর গ্রামে আমাদের কর্মীদের পিকনিক ছিল। কোথাও অশান্তি করতে যাননি কর্মীরা। সেখানেই বচসা থেকে ঝামেলা হয়।’’ যা শুনে বিজেপি-র বক্তব্য, পিকনিকে বোমা-বন্দুকের কী কাজ!