(বাঁ দিক থেকে ডান দিকে) বসুন্ধরা রাজে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
উত্তরপ্রদেশের সুচেতা কৃপালনী থেকে জম্মু-কাশ্মীরে মেহবুবা মুফতি— দেশ এখনও পর্যন্ত মোট ১৬ জন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছে। কিন্তু বসুন্ধরা রাজেকে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রিত্বের চেয়ারে বিজেপি বসতে না দেওয়ায় দেশে ‘একা কুম্ভ’ হয়ে রইলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই এখন ভারতের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী।
মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় এবং রাজস্থানে যে জয় বিজেপি পেয়েছে, তাতে কোনও একটি রাজ্যে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী করার ঝুঁকি নিতে পারত তারা। কিন্তু জাতপাতের অঙ্ক কষে তিন রাজ্যে অন্যান্য অনগ্রসর (ওবিসি) শ্রেণির মোহন যাদব, আদিবাসী বিষ্ণুদেও সাই এবং ব্রাহ্মণ ভজনলাল শর্মাকে বেছে নিয়েছে বিজেপি। দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা অন্যতম দাবিদার হলেও তাঁকে ‘অস্তাচলে’ যেতে হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে। বসুন্ধরা দলের পিছনের সারিতে চলে যাওয়ায় এ বার বিজেপিতে ‘মহিলা মুখ’ বলতে প্রায় কেউই রইলেন না। এই মুহূর্তে দেশের ১২টি রাজ্যে একক ভাবে এবং পাঁচটিতে জোট গড়ে ক্ষমতায় বিজেপি। কিন্তু সেই ১৭ রাজ্যের কোথাও নেই মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। দলের সংগঠনেও প্রথম সারিতে কোনও চেনা মহিলা মুখ নেই।
তবে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পালের কথায়, ‘‘বিজেপিতে মহিলা মুখ নেই, এ কথা আমি কী করে বলি? এই রাজ্যেই সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়, দেবশ্রী চৌধুরীরা কি মহিলা মুখ নন? আর মোদীজি মহিলাদের কথা যতটা ভেবেছেন ততটা কেউ কখনও ভাবেননি। এত মহিলা মন্ত্রী কোনও আমলেই কেন্দ্রে ছিলেন না।’’
অনেকেই মনে করেন, বিজেপি বরাবর ‘পুরুষতান্ত্রিক’ দল। অটলবিহারী বাজপেয়ী থেকে জেপি নড্ডা— এখনও পর্যন্ত দলের ১১ জন সর্বভারতীয় সভাপতিই পুরুষ। এই মুহূর্তে দেশে বিজেপির রাজ্য সভাপতিদের মধ্যে মাত্র দু’জন মহিলা। অন্ধ্রপ্রদেশে ডি পুরাণ্ডেশ্বরী এবং মণিপুরে সারদা দেবী। বিজেপি অবশ্য সংবিধান মেনে দলের সব কমিটিতেই নির্দিষ্ট সংখ্যায় মহিলা প্রতিনিধিত্ব রাখে। দলের সর্বোচ্চ কমিটি সংসদীয় বোর্ডেও ১১ জন পুরুষের মধ্যে একা মহিলা হরিয়ানার নেত্রী সুধা যাদব। ‘বড়’ দায়িত্ব হতে পারে, কিন্তু তিনি কোনও ভাবেই দলের ‘ছোট মুখ’-ও নন।
এ নিয়ে বাংলার শাসক তৃণমূল বরাবরই বিজেপিকে দুষে এসেছে। গেরুয়া শিবিরকে বিভিন্ন সময়ে ‘নারীবিদ্বেষী’ বলে আক্রমণও করেছেন তৃণমূল নেতারা।
নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভায় ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ একা। বছর দু’য়েক প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও সামলেছেন। কিন্তু দলের সংগঠনে বিশেষ জায়গা নেই নির্মলার। এ ছাড়া পূর্ণমন্ত্রী রয়েছেন স্মৃতি ইরানি। অভিনয় জগৎ থেকে রাজনীতিতে আসা স্মৃতিকে দলের প্রচারে ‘তারকা’ হিসাবে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, ‘সংগঠক’ হিসাবে ততটা নয়। অমেঠি কেন্দ্রে রাহুল গান্ধীকে হারানো স্মৃতির বার বার দায়িত্ব বদলেছে মন্ত্রিসভায়। শুরুতে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী হলেও তাঁকে ঘিরে বিতর্কের পরে সে ভাবে আর প্রথম সারির মন্ত্রক পাননি। মোদী মন্ত্রিসভায় ১১ মহিলার মধ্যে বাকি ন’জনের সকলেই ‘প্রতিমন্ত্রী’।
তবে বিজেপি এমন দাবি করতেই পারে যে, তারা ১১ জন মহিলাকে মন্ত্রী করেছে। যা অতীতে কখনও হয়নি। মোদীর প্রথম মন্ত্রিসভায় ১৭ জন মহিলা ছিলেন। সেটিই দেশে সর্বোচ্চ। ইতিহাস বলছে, জওহরলাল নেহরুর সময় এক জন, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সময়ে তিন জন, বাজপেয়ীর সময়ে এক জন মহিলা জায়গা পেয়েছিলেন মন্ত্রিসভায়। এখনও পর্যন্ত দেশের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তিনটি সরকারের একটিতেও কোনও মহিলা পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন না। তবে মনমোহন সিংহের প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় পূর্ণ ও প্রতিমন্ত্রী মিলিয়ে ১০ জন করে মহিলা ছিলেন।
তবে বিজেপি যেমন দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছে, তেমনই কংগ্রেস আমলে শীর্ষ সাংবিধানিক পদে বসেছিলেন প্রতিভা পাটিল। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে বিজেপির চোখে মূল পরিচয় তিনি ‘আদিবাসী’। তাঁকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করার পরেই বিজেপি নেতৃত্ব ‘প্রথম আদিবাসী রাষ্ট্রপতি’ বলে প্রচারে নেমেছিলেন।
মোদীর বিজেপি ‘বেটি পড়াও, বেটি বচাও’ স্লোগান তুলেছে। তিন তালাক নিষিদ্ধ করার কৃতিত্বও তাদেরই। লোকসভায় ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ বিল (কার্যকর হবে ২০৩৯ সাল থেকে) পাশ করানো নিয়ে গর্বও করতে পারে। কিন্তু বাস্তব বলছে, বসুন্ধরাকে সরিয়ে দেওয়ার পরে বিজেপির আর কোনও বড় কোনও ‘মহিলা মুখ’ রইল না।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার সময় মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর সিংহাসন আনন্দীবেন পটেলকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা দু’বছর ৭৭ দিনের জন্য। পরে রাজ্যপাল হয়ে যাওয়ায় আলো থেকে সরে গিয়েছেন আনন্দীবেন। দল এবং সরকারের প্রথম সারিতে থাকা সুষমা স্বরাজ প্রয়াত। মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উমা ভারতী বা লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের নাম সে ভাবে শোনা যায় না। মেনকা গান্ধী দ্বিতীয় মোদী মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি। ছিলেন বসুন্ধরা। তিনিও এ বার আড়ালে চলে গেলেন। আগামী লোকসভা নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থী করা হয় কি না বা বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হয় কি না, সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে।
বসুন্ধরার গুরুত্বের পিছনে আরও কারণ ছিল রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরাধিকার বহন করা। যে ভাবে সনিয়া গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা, এনসিপির সুপ্রিয়া সুলে, ডিএমকের কানিমোঝিরা পারিবারিক ধারা বজায় রেখে রাজনীতিতে এসেছেন। একই কথা প্রযোজ্য বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবীর ক্ষেত্রেও। দীর্ঘ সময় তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী থাকা জয়ললিতাও সম্পর্কের উত্তরাধিকারের সূত্রেই রাজনীতির শীর্ষে উঠেছিলেন। তবে পারিবারিক পরিচয় ছাড়া জাতীয় রাজনীতিতে দলিত নেত্রী হিসাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী। কিন্তু ‘বহেনজি’-র দিন আর নেই। ফলে জাতীয় রাজনীতিতেও এখন ‘একা কুম্ভ’ বাংলার ‘দিদি’। যদিও তাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ অগ্নিমিত্রা। বিজেপির মহিলা বিধায়কের কথায়, ‘‘এটা ওঁর নিজের দল বলে উনিই সব! তৃণমূল কি এটা বলতে পারবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেও কোনও মহিলাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেন? হবেন তো তাঁর পরিবারের কোনও পুরুষ উত্তরসূরিই। আমাদের দলে নারী-পুরুষ ভেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় না। যোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতাই প্রথম ও প্রধান মাপকাঠি।’’