Parliament Security Breach

নিরীহ রঙের বদলে বিষাক্ত গ্যাস থাকলে কী হত? ৮৬২ কোটি টাকায় গড়া নয়া ভবনে সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন

প্রশ্ন উঠেছে, যদি নিরীহ রঙের পরিবর্তে সেখানে বিষাক্ত গ্যাস থাকত, তা হলে কী হত? বা যদি সি-৪ বা সেমট্যাক্স-এর মতো প্ল্যাস্টিক বিস্ফোরক নিয়ে কেউ প্রবেশ করত, তা হলেও কি ধরতে পারতেন না নিরাপত্তাকর্মীরা?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:২৩
Share:

নতুন সংসদ ভবন। ছবি: রয়টার্স।

নিরাপত্তায় ফাঁক ছিল ২২ বছর আগেও। যার সুযোগ নিয়ে সংসদে হামলা চালিয়েছিল পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিরা। আর আজ সেই হামলার বর্ষপূর্তির দিনে লোকসভার অভ্যন্তরে সাংসদদের বেঞ্চের উপর দিয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে দুই যুবক গ্যাস ক্যানিস্টারের রং স্প্রে করার ঘটনা বুঝিয়ে দিল, নিরাপত্তার সেই ফাঁক রয়ে গিয়েছে ২২ বছর পরেও।

Advertisement

আজ লোকসভার শূন্য প্রহর যে নজিরবিহীন কাণ্ডের সাক্ষী থাকল, তা ফের এক বার প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সংসদ ভবনের নিরাপত্তাকে ঘিরে। আজ ওই দুই অভিযুক্ত ব্যক্তি দর্শক হিসেবে প্রবেশ করেন। চারটি নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে আসা সত্ত্বেও তাঁদের পায়ের জুতোর সুখতলার নিচে যে প্ল্যাস্টিকের রঙের ক্যানিস্টার রয়েছে, তা ধরতে ব্যর্থ হয় যন্ত্র ও নিরাপত্তা রক্ষী— উভয়েই। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যদি নিরীহ রঙের পরিবর্তে সেখানে বিষাক্ত গ্যাস থাকত, তা হলে কী হত? বা যদি সি-৪ বা সেমট্যাক্স-এর মতো প্ল্যাস্টিক বিস্ফোরক নিয়ে কেউ প্রবেশ করত, তা হলেও কি ধরতে পারতেন না নিরাপত্তাকর্মীরা? কংগ্রেস সাংসদ কার্তি চিদম্বরমের মতে, ‘‘এ ভাবে যদি অ্যানথ্রাক্সের মতো কোনও বিপজ্জনক জীবাণু ছড়িয়ে দিতেন ওই যুবকেরা, তা হলে কী হত?’’ আজকের ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে, কেবল সংসদই নয়, সরকারি দফতর, ব্যাঙ্ক, বিমানবন্দরের মতো দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে সরকারকে।

পাশাপাশি, আজ সংসদ হামলার বর্ষপূর্তি ছাড়াও সংসদে হামলার হুমকি দিয়েছিলেন খলিস্তানপন্থী নেতা গুরপতবন্ত সিংহ পন্নুন। আজ যে অপ্রীতিকর কিছু হতে পারে, সে বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন গোয়েন্দারা। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে সেই ‘ইনটেলিজেন্স অ্যালার্ট’ ছিল। তা সত্ত্বেও প্রবেশের ক্ষেত্রে যে দেহতল্লাশি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল, তাতে নজরদারির অভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আজ দুই যুবক নিজেদের জুতোর সুখতলার নীচে ওই গ্যাস ক্যানিস্টার লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সূত্রের খবর, ওই জুতোগুলি আর পাঁচটি সাধারণ জুতোর মতো নয়। তা বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছিল যাতে ওই গ্যাস ক্যানিস্টার লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এই ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে, ওই দুই ব্যক্তি চারটি নিরাপত্তা পয়েন্ট পার হওয়া সত্ত্বেও ওই বিশেষ জুতো নজরদারি ও তল্লাশির দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের মধ্যে কোনও প্রশ্ন জাগায়নি।

Advertisement

আজ দুই যুবক কর্নাটকের বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহা্‌র সই করা পাস নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। প্রশ্ন উঠছে, ওই যুবকদের কি আদৌও চিনতেন ওই সাংসদ। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংসদদের নামে সই করা পাস যাঁদের নামে ইস্যু হয়, তাঁদের অধিকাংশকেই সাংসদেরা চেনেন না। ফলে ওই ব্যবস্থা আগামী দিনে কতটা চালু থাকবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর তা বুঝেই আজ ওই ঘটনার পরে স্পিকার ওম বিড়লার ডাকা সর্বদল বৈঠকে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরীর পরামর্শ, আজকের ঘটনার জন্য সংসদকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলবেন না। দর্শকদের প্রবেশ একেবারে বন্ধ হওয়া কাম্য নয়। কারণ এলাকার লোকের এ নিয়ে সাংসদদের উপরে চাপ থাকে। আগের সংসদে যে সব ব্যবস্থা ছিল, তা-ই যেন নতুন সংসদে চালু থাকে, মত অধীরের।

আজ সর্বদল বৈঠকের পরে লোকসভার সেক্রেটারি জেনারেল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে লোকসভার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য চিঠি দিয়েছেন। ওই আবেদনের ভিত্তিতে রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, সংসদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে সিআরপিএফের ডিজি আশিস দয়াল সিংহের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা কী ভাবে আজ নিরাপত্তার ত্রুটি হয়েছিল তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি সার্বিক ভাবে নিরাপত্তার যে ত্রুটিগুলি রয়েছে তা-ও খতিয়ে দেখে পরামর্শ দেবে। কমিটি দ্রুত তাদের পরামর্শ সরকারের কাছে জমা দেবে।

আপাতত দর্শক গ্যালারিতে প্রবেশ বন্ধ থাকছে। সূত্রের মতে, সাংসদদের ব্যক্তিগত সচিবদেরও সংসদের ভিতরে প্রবেশে কড়াকড়ি শুরু হতে চলেছে। সংসদের অভ্যন্তরে চলাচলে কড়া নিয়ম চালু হতে চলেছে সংবাদমাধ্যমের উপরেও।

আজকের ঘটনার পরে সংসদের নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের দাবি, অবিলম্বে খালি থাকা পদগুলিতে নিয়োগ শুরু করা হোক। গত কয়েক বছর ধরেই সংসদে নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। সূত্রের মতে, নিরাপত্তাকর্মীদের সিকিওরিটি অ্যাসিট্যান্ট গ্রেডের মোট পদ ৩০১। কর্মরত রয়েছেন ১৭৫ জন। খালি পদ রয়েছে ১২৬টি। বাইশ বছর আগে জঙ্গিরা যখন হামলা চালিয়েছিল, তখন জঙ্গিদের বাধা দিতে ওই কর্মীদের বেশ কয়েক জন নিহত হয়েছিলেন। তা ছাড়া, এত দিন পুরোনো সংসদ ভবনে দর্শক গ্যালারির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতেন সংসদের নিরাপত্তারক্ষীরা। কিন্তু নতুন সংসদে তাঁদের পরিবর্তে মূলত সিআরপিএফ কর্মীদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অতীতে দর্শকদের সামলাতে সংসদীয় কর্মীরা প্রতিটি আসনে বসা দর্শকদের উপরে নজর রাখতেন। কাউকে সামনের সারিতে সামান্য ঝুঁকতে দিতেন না। পুরনো সংসদের নিরাপত্তারক্ষীরা এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, দর্শকেরা সামান্য নড়াচড়া করলে, ঘাড় ঘোরালে বা কথা বললেই তাঁদের পাশে পৌঁছে যেতেন। তাঁদের বারণ করতেন। কিন্তু নতুন সংসদে নিরাপত্তারক্ষীরা দর্শক গ্যালারির একেবারে শেষ আসনে বসে নজর রাখছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে আজ দু’জন লাফ দিয়ে নামা সত্ত্বেও তাঁদের কাছে দ্রুত পৌঁছে গিয়ে তাঁদের আটকাতে ব্যর্থ হন নিরাপত্তারক্ষীরা। যা ওই কর্মীদের প্রশিক্ষণের গাফিলতিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে ৮৬২ কোটি টাকায় গড়া নতুন সংসদ ভবনের নকশা নিয়েও। পুরনো সংসদ ভবনটি এমন ভাবে তৈরি ছিল, যাতে সহজেই প্রবেশ করতে ও বেরিয়ে যেতে পারতেন সাংসদেরা। তৃণমূলের এক সাংসদের কথায়, ‘‘নতুন সংসদ ভবনটি ভুলভুলাইয়া বললে কম হবে। কোথা থেকে প্রবেশ করব, কোথা দিয়ে বার হব, তা এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।’’ আজও যেমন সাংসদেরা কোন পথ দিয়ে বেরোবেন বুঝতে পারছিলেন না। ফলে এই ধরনের আপৎকালীন অবস্থায় কোন পথে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসা উচিত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। নতুন সংসদে প্রবেশের জন্য সাংসদদের স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছিল, যাতে সাংসদদের মুখ দেখেই দরজা খুলে যায়। কিন্তু সেই ব্যবস্থা এখনও চালু হয়নি। আজকের ঘটনার পরে সংসদের অভ্যন্তরে অবাঞ্ছিতদের রুখতে সাংসদদের সবাইকেই সংসদের সচিবালয় থেকে স্মার্ট কার্ড নিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement