মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ছবি পিটিআই।
পুরোদস্তুর পুরনো মমতা। দল থেকে সরকার, সংগঠন থেকে নির্বাচন— নানা ক্ষেত্রে একের পর এক বড় সিদ্ধান্ত এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা করলেন দিনভর। কখনও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি যাচ্ছেন না নীতি আয়োগের বৈঠকে। কখনও হুগলির তৃণমূল নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসে জোরদার দাবড়ানি দিলেন গোষ্ঠী বিবাদে অভিযুক্তদের। তার পরেই আবার সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকলেন ফুরফুরে মেজাজে। জনসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ফের তোপ দেগে দাবি তুললেন, কলেজিয়ামের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার বাছার।
লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরনোর পর থেকে তৃণমূল চেয়ারপার্সনের মেজাজ যে মোটেই ভাল ছিল না, তা আন্দাজ করার দরকার পড়ছিল না। ফলাফল পর্যালোচনার বৈঠক, বৈঠকের পরে সাংবাদিক সম্মেলন, দলের কোর কমিটির বৈঠক, নবান্নে বিধায়ক-সাংসদদের নিয়ে বৈঠক— কোনওটাতেই মনে হয়নি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুরনো মেজাজে রয়েছেন। কিন্তু শুক্রবার আবহাওয়ায় বেশ বদল লক্ষ্য করা গেল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল এ দিন, তিনি ফের আত্মবিশ্বাসী এবং চেনা চনমনে।
প্রথম চমকটা শুক্রবার বেশ সকাল সকালই দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ জুন দিল্লিতে নীতি আয়োগের যে বৈঠক হওয়ার কথা, সেখানে তিনি যাচ্ছেন না, খবর মেলে সকালেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি পাঠিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছেন যে তিনি নীতি আয়োগের বৈঠকে থাকছেন না, জানা যায় নবান্ন সূত্রে। নীতি আয়োগকে তিনি কতখানি অক্ষম মনে করেন, নীতি আয়োগের সঙ্গে পূর্বতন যোজনা কমিশনের ফারাক কোথায় এবং কেন তিনি বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন— চিঠিতে বিশদে লিখে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিকেলে তৃণমূল ভবনে হওয়া এক সাংবাদিক সম্মেলনেও তিনি বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্ঘাত জারি, মোদীর ডাকা নীতি আয়োগ বৈঠকে যাচ্ছেন না মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, এই নীতি আয়োগের চেয়ে আগের যোজনা কমিশন অনেক বেশি ‘কর্মক্ষম’ ছিল। আন্তরাজ্য পরিষদ বা ইন্টার স্টেট কাউন্সিল তুলে দিয়ে রাজ্যগুলির মতামতকে গৌণ করে দেওয়া হয়েছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘‘নীতি আয়োগের কোনও ক্ষমতা নেই, শুধু লোকদেখানো। এই বৈঠকে গিয়ে কোনও লাভ হয় না।’’
আরও পড়ুন: গজলডোবায় জমি বিক্ষোভে মন্ত্রী গৌতম দেবকে গো ব্যাক ধ্বনি, কালো পতাকা
শুধু নীতি আয়োগের বিরুদ্ধে নয়, নির্বাচন আয়োগের বিরুদ্ধেও এ দিন ফের সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ফের ভোটযন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তো তুলেছেনই, যথেচ্ছ টাকা ছড়ানোর অভিযোগও তুলেছেন। তবে নির্বাচনী সংস্কারের যে দাবি তিনি অনেক দিন ধরেই তুলছেন, সে প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন একটি নতুন সংযোজন করেছেন। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করার জন্য কলেজিয়াম গঠন করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেছেন এ দিন। কেন্দ্রের মনোনীত তিন জন ব্যক্তি গোটা নির্বাচনটা পরিচালনা করবে, এটা চলতে পারে না বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ করার জন্য যেমন কলেজিয়ামের ব্যবস্থা রয়েছে, তেমনই নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের জন্যও কলেজিয়াম থাকা উচিত— তৃণমূল চেয়ারপার্সন এ দিন এমন দাবিই তুলেছেন।
হুগলি জেলার নির্বাচনী ফলাফল পর্যালোচনা করার জন্যই মূলত এ দিন তৃণমূল ভবনে বৈঠক ডেকেছিলেন মমতা। দলের বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারীরা এবং বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা বৈঠকে ডাক পেয়েছিলেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর বার্তা দিয়েছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন। সিঙ্গুর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির চেয়ে তৃণমূলের পিছিয়ে পড়া নিয়েও তিনি অত্যন্ত রুষ্ট বলে খবর। যে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্ত ছিল সিঙ্গুরে কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করা, সেই সিঙ্গুরেই তৃণমূলের হার প্রতীকী ভাবে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালই বোঝেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা এবং জনপ্রতিনিধিরা এ দিন তাই নেত্রীর তীব্র তোপের মুখে পড়েন বলে খবর। অবিলম্বে হারানো জমি পুনরুদ্ধারের জন্য সকলকে এক হয়ে ঝাঁপাতে তিনি নির্দেশ দেন এ দিনের বৈঠকে।
বৈঠক এ দিন শুধু হুগলি জেলাকে নিয়ে করেছেন। কিন্তু সাংগঠনিক রদবদল এনেছেন উত্তরবঙ্গেও। কোচবিহার জেলা তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষকে শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরিয়ে দিয়েছেন। সেই দায়িত্ব দিয়েছেন বিনয় বর্মণকে। কোচবিহারে দলের ফলাফলের প্রেক্ষিতেই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রদবদল করলেন, তা বেশ স্পষ্ট।
শুধু রদবদল আর দাবড়ানিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেমে থাকেননি। লোকসভা ভোটে ধাক্কা খেয়ে ঈষৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়া দলকে চাঙ্গা করতে বড়সড় জনসংযোগ কর্মসূচি এ দিন তিনি ঘোষণা করেছেন। ২১ জুন থেকে তৃণমূলের জনসংযোগ যাত্রা শুরু হচ্ছে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন জানিয়েছেন। পশ্চিম মেদিনীপুর, সুন্দরবন, উত্তরবঙ্গ-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই জনসংযোগ যাত্রাগুলি শুরু হবে। বিভিন্ন ব্লককে ছুঁতে ছুঁতে কোন কোন পথে এই সব যাত্রা এগোবে, সে সবও এ দিন অনেকটাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূল চেয়ারপার্সন।
১৮ জুলাই অবশ্য যাত্রা থেমে যাবে। ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের জন্য ওই দিন যাত্রা থামিয়ে গোটা বাংলা থেকেই সংগঠনকে ধর্মতলামুখী করবেন মমতা। ২৫ জুলাই থেকে আবার যাত্রা শুরু হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।