এক বধূর বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে দাবি করে সালিশি সভা বসিয়ে তাঁকে চরিত্রহীন অপবাদ দিয়ে মারধরের পরে চুল কেটে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একদল গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে। তাতে মহিলারাও সামিল হয়েছিলেন। ওই বধূর স্বামীকেও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আলিপুরদুয়ারের কুমারগ্রামের পশ্চিম নারারথলি গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে।
এই ঘটনায় বুধবার গ্রামের দু’জন পুরুষ ও ৬ জন মহিলার নামে কুমারগ্রাম থানায় লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তৃণমূল কর্মী বলে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের পক্ষ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। ঘটনার পরেই অভিযুক্তরা সকলেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। থানায় অভিযোগ জানানোর পরে অভিযুক্তদের বাড়ির লোকজন নির্যাতিতা মহিলা ও তাঁর স্বামীকে ক্রমাগত হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ। ঘটনার পরে ওই মহিলা ও তাঁর স্বামী দুই সন্তানকে নিয়ে কামাখ্যাগুড়িতে বাপের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে সন্তোষ বিশ্বাস নামে এক তৃণমূল কর্মী ও নৃপেন তালুকদার নামে এক সিপিএম কর্মী রয়েছেন। আলিপুরদুয়ারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া বলেন, “ওই গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ওই মহিলা ও তাঁর স্বামীর নিরাপত্তার সব রকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। অভিযুক্ত সকলকে গ্রেফতার করার জন্য তল্লাশি চলছে।”
এলাকার তৃণমূল নেতা মিহির নার্জিনারি বলেন, “ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। আমরা চাই, এই ঘটনায় যারা অভিযুক্ত তাদের শাস্তি হোক।” তিনি বলেন, “আমরা জেনেছি প্রথমে ৪২ জন গ্রামবাসীর নামে অভিযোগ লেখা হয়। পরে দেখা যায় মাত্র ৮ জনের নামে অভিযোগ জানানো হয়েছে। প্রকৃত দোষীদের বাদ দিয়ে নির্দোষ কয়েকজনের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত দোষীরা যাতে প্রত্যেকেই শাস্তি পান, সেটা দেখতে পুলিশের কাছে আর্জি জানাব।” এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য মনোজ বর্মন বলেন, “খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে গিয়ে মহিলাকে উদ্ধার করে পুলিশে খবর দিয়েছি। অভিযুক্তদের বাঁচানো ও আড়াল করার অভিযোগ ঠিক নয়।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর খানেক আগে প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে ওই মহিলার সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই যুবকের সঙ্গে সেই বধূ পালিয়েও যান। সপ্তাহখানেক পরে তাঁর স্বামী তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। এরপরেই গ্রামে সালিশি সভা বসে হুমকি দেওয়া হয়, ফের এমন ঘটলে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে। ফের ওই যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যান ওই বধূ। তাঁর স্বামী তখন ওই যুবকের বিরুদ্ধে তাঁর স্ত্রীকে অপহরণের অভিযোগ করেন থানায়। পুলিশ ওই যুবককে গ্রেফতার করে। ওই বধূকে তাঁর স্বামীর হাতে তুলে দেয়। তিনি স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসেন সপ্তমীর দিন। এর পরেই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গ্রামের একদল মহিলা পুরুষ ওই বধূকে বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে পুজো মণ্ডপের মাঠে নিয়ে যান। সেখানে ব্যাপক মারধর করা হয় তাঁকে। চুলও কেটে নেওয়া হয়।
ওই মহিলার বক্তব্য, “আমি স্বামীকে ছেড়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে গিয়ে ভুল করেছি। স্বামীর কাছে ভুল স্বীকার করায় তিনি আমাকে মেনে নিয়েছেন। এর পর ওরা আমার উপর যে ভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, সেটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সারা শরীরে কালশিটে পড়েছে। স্বামী বাঁচাতে গেলে তাকেও প্রচন্ড মারধর করা হয়েছে। ওরা এখনও হুমকি দিচ্ছে। গ্রামে থাকতে ভয় হচ্ছে। তাই বাপের বাড়ি চলে এসেছি। যদিও পুলিশ আমাকে সবরকম সাহায্য করছে।” তাঁর দাবি, “যারা আমার উপর এমন নির্যাতন চালিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের শাস্তি চাই।”
তাঁর স্বামীর বক্তব্য, “আমার স্ত্রী চরিত্রহীন কি না, সেটা আমাকে ভাবতে দিক। গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে যেভাবে আমাদের মারধর করে স্ত্রীর মাথার চুল কেটে নিয়েছে তার বিচার চাই। আমাদের গ্রামছাড়া করার জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে। তৃণমূলের কয়েকজন নেতা অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে কাজ করছে। এর পর আমরা গ্রামে থাকতে পারব কি না জানি না। অভিযুক্ত প্রত্যেকের শাস্তি চাই।”
অভিযুক্ত তৃণমূল কর্মী সন্তোষ বিশ্বাস ও সিপিএম কর্মী নৃপেন তালুকদার বলেন, “আমরা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই। অথচ আমাদের নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এলাকার এক বিজেপি নেতা ও তার স্ত্রী জড়িত থাকলেও তাদের আড়াল করা হচ্ছে।” বিজেপির আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি সভাপতি গুণধর দাস বলেন, “বিজেপির কেউ এই ঘটনায় জড়িত নয়। তৃণমূল ও সিপিএমের কর্মী সমর্থকরাই ওই বধূর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।”