ছবি: সন্দীপ পাল
কী খেয়ে, কেমন করে দিনের পর দিন বেঁচে আছেন ওঁরা? ভেবেছিলেন মন্ত্রীরা বাগানে এসে দেখে যাবেন তা। সেই স্বপ্ন পূরণ হল না মেরি মুণ্ডাদের। গাড়ির কনভয় নিয়ে মন্ত্রীরা এলেন। বস্তিতে না-ঘুরে পাকা ঘরের বারান্দায় বসে কিছু কথা বলে আবার ফিরেও গেলেন। রবিবার বিকেলে তাই স্বপ্নগুলি মিইয়ে গেল ওদের ঘরের নিভন্ত উনুনের মতই। চেনা হতাশাই ফের গ্রাস করল বন্ধ রায়পুর চা বাগানের মেরির মতো কয়েকশো শ্রমিককে।
এ দিন ঘর ছেড়ে একবারও বাইরে যাননি সাঁওতাল লাইনের মেরি মুন্ডা, মানকি মুণ্ডা, দশরথ খেরিয়া, সানিয়া মুণ্ডারা। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বস্তিতে আসবেন তাঁদের দুর্দশার কথা শুনতে। শনিবার বিকেলে এমন খবর পেয়ে, আড়াই বছরের ছেলে দীপককে নিয়ে রবিবার সকাল থেকেই অপেক্ষা করছিলেন মানকি। বিকেলে কয়েক পশলা বৃষ্টি টিনের চালের ফাঁক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে ভাসিয়ে দিয়েছে মাটির মেঝে। প্যাচপেচে কাদা ঘরে। সেখানে বসে খড়ির উনুনে ভাত ফুটিয়েছেন। বেলা গড়াতে আলু সেদ্ধ দিয়ে খাওয়া সেরেছেন। বিকেল তিনটের পরে স্বামী ভরত যখন জানালেন ফিরে গিয়েছেন মন্ত্রীরা দীর্ঘশ্বাস চাপতে পারেননি মানকি মুন্ডা। উদাস হয়ে বলেন, “এত কাদা জল, ওঁরা কি আসে!”
সকাল থেকে চা বাগানের চেনা ছবিটা যেন অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল এ দিন। বাগানের পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে এ দিন দুপুর আড়াইটে নাগাদ দুই মন্ত্রী রায়পুর চা বাগানে আসেন। শ্রমিক সংগঠনগুলোর তৈরি পরিচালন সমিতি পাতা তোলার কাজ শুরু করে, স্পেশাল জিআর দেওয়া হয়। বাগান অফিস চত্বরে জেলা পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা ভিড় করেন। কিছু শ্রমিক আশপাশে এলে, মন্ত্রীরা শ্রমিকবস্তিতে যাবেন জেনে মেরি মুণ্ডার মতো বেশির ভাগ শ্রমিক বাড়িতেই ছিলেন। মন্ত্রীরা বাগানে পৌঁছে চলে যান অফিস ঘরের বারান্দায়। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে চলে যান। যাওয়ার আগে খাদ্যমন্ত্রী দাবি করেন, “অপুষ্টিতে মৃত্যুর কথাটা ঠিক নয়।” সাঁওতাল লাইনের বাসিন্দা খেতিয়া ভূমিজ, বুধুয়া খেরিয়ারা ঢেকে রাখা সেদ্ধ ভাত আর ঢেঁকি শাক মন্ত্রীদের দেখানোর সুযোগ পাননি আর। কনভয় বাগান ছেড়ে জলপাইগুড়ি সার্কিট হাউসের দিকে রওনা দিতে মন্ত্রীদের বক্তব্যে অবাক শ্রমিকরা তাই আক্ষেপ করলেন “মন্ত্রীরা এলেন। অনেক আশা ছিল বস্তিতে যাবেন। আমরা কী খাই, কতটা অপুষ্টিতে আছি, সেটা দেখবেন। তা আর হল না।”
বাগানে কী অপুষ্টির সমস্যা নেই? আইসিডিএসের প্রকল্প আধিকারিক দেবদাস বিশ্বাস জানান, বাগানে ছয়টি সেন্টার রয়েছে। খোঁজ নিয়ে ১১টি শিশুর খোঁজ মিলেছে যারা অপুষ্টিতে ভুগছে। তাঁদের দু’বার পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে। যদিও শ্রমিকদের দাবি, সংখ্যাটা যে অনেক বেশি হবে। সেটাই তাঁরা এদিন মন্ত্রীদের দেখাতে চেয়েছিলেন। স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য প্রধান হেমব্রম বলেন, “শুধু ভাত খেয়ে পুষ্টি হয় না, ভাতের সঙ্গে ডাল, সব্জি লাগে। সেটাই তো কেনার পয়সা বাগানের শ্রমিকদের নেই।” মন্ত্রীরা যে অন্য কথা বলে গেলেন? পঞ্চায়েত সদস্য হেসে জানান, “ওই বিষয়ে কিছু বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।” যদিও গাঙ্গি মুণ্ডা, বড়কু মুণ্ডার মতো শ্রমিকরা ক্ষোভ উগড়ে দিতে ছাড়েননি। তাঁদের প্রশ্ন, “আমরা কেমন আছি সেটা নিজে না দেখে কেন মন্ত্রীরা অন্য কথা বলছেন।”
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক: আপনারা রেশনে চাল পাচ্ছেন?
প্রধান হেমব্রম: চাল পাচ্ছি না। পোকায় কাটা চালের গুেঁড়া পাচ্ছি।
জ্যোতিপ্রিয়: কেন? ওই চালের নমুনা আসুন তো। কত পরিমাণে পাচ্ছেন ৫ কেজি তো?
কাজল ঘোষ: না স্যার। সাড়ে তিন কেজি করে পাই। পাশ থেকে সুগ্রীব ভূমিজ ও বুধুয়া মুণ্ডা: দুর্গন্ধে ভরা রেশনের চাল খাওয়া যায় না।
জ্যোতিপ্রিয়: চিনি, গম, আর কেরোসিন তেল সব পান তো?
শ্রমিকরা: হ্যাঁ স্যার, পাই।
জ্যোতিপ্রিয়: কেরোসিন তেল ১৩ টাকা ৫০ পয়সা করে নেয় তো?
কাজল ঘোষ: না স্যার। ১৪ টাকা।
গৌতম দেব: একশো দিনের কাজ পান না?
প্রধান হেমব্রম: হ্যাঁ পাই, তবে এক বার কাজ পেলে তার পরে দু’মাস আর পাই না। কখনও ৩ বা ৫ মাসও লেগে যায় কাজ পেতে।
গৌতম: (জেলাশাসকের দিকে তাকিয়ে): কেন এমন হবে? খোঁজ নিন।
প্রধান হেমব্রম: কখনও টাকা পেতেও দু’তিন মাস লাগে।
গৌতম: বাগানে জলের কী অবস্থা?
প্রধান হেমব্রম: পাত কুয়ো আর রিং কুয়োর জল খেয়ে থাকতে হয়। তাই, সারা বছর পেটের রোগে ভুগি।
গৌতম: এখানে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র কটি রয়েছে?
ববিতা ওঁরাও: ৬টি, কিন্তু সেখানে কোনও দিন চাল থাকলে ডিম থাকে না, আবার ডিম থাকলে চাল নেই। ছেলেমেয়েগুলি খেতে পায় না।
গৌতম: অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কোথায় রান্না হয়?
ববিতা ওঁরাও: দুটি কেন্দ্রে রান্নাঘর নেই স্যার। খোলা আকাশের নীচে রান্না হয়। কখনও ত্রিপল টাঙায়।
জ্যোতিপ্রিয়: আর কী কী সমস্যা আছে?
ববিতা ওঁরাও: ভাঙাচোরা ঘরে থাকি। কয়েক দশক ধরে ঘরে কাজ হয়নি। অনেকের বাড়িতেই ছাদ নেই, দেওয়াল ধসে গিয়েছে, রাতে অন্য বাড়িতে শুতে যেতে হয়।
প্রধান হেমব্রম: স্যার দয়া করে, শ্রমিক লাইনগুলিতে চলুন। আমাদের দুর্দশা দেখবেন চলুন।
গৌতম: বাগানে স্কুল আছে?
প্রধান হেমব্রম: একটা প্রাথমিক স্কুল আছে। মিড ডে মিল ভাল না।
(ভগত লাইনের যুবক পউলুস মুণ্ডা চালের নমুনা নিয়ে এসেছেন। তা দেখে বিব্রত খাদ্যমন্ত্রী জেলা খাদ্য নিয়ামককে তদন্তের নিদের্শ দিলেন।)
জ্যোতিপ্রিয়: আমি বলে দিলাম, আর এমন চাল দেবে না। জেলা থেকে সংগ্রহ করা ভাল চাল দেওয়া হবে।
প্রধান হেমব্রম: স্যার বাগান খোলার ব্যবস্থা করুন। মালিককে ডেকে পাঠান।
গৌতম: নিশ্চয় করা হবে। আপনি কী শ্রমিক নেতা?
প্রধান হেমব্রম: আমি পঞ্চায়েত সদস্য।
গৌতম: কোন দলের?
প্রধান হেমব্রম: তৃণমূল।
গৌতম: পঞ্চায়েত কোন দলের?
প্রধান হেমব্রম: তৃণমূল।
শ্রমিকরা মন্ত্রীদের বাগান ঘুরে দেখার আর্জি জানান। তখন মন্ত্রীরা জানান, সার্কিট হাউসে গিয়ে বৈঠক করতে হবে। সেই বৈঠকে শ্রমিকদের সাহায্যের সিদ্ধান্ত হবে। বাগানের ভিতরে গেলে, বৈঠকে দেরি হয়ে যাবে বলে মন্ত্রীরা শ্রমিকদের জানান। পরে অবশ্য ফের বাগানে আসার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।