দুর্নীতির অভিযোগ মুছে যাক, চায় শহর

আরও একটা ভোট! আবারও হইহল্লা চলবে। হবে অভিযোগের চাপানউতোর। ভোটের বাজারে নেতা-কর্মীদের একাংশের নানাবধি আশ্বাস, আস্ফালনও শুনতে হবে শহরবাসীকে। কিন্তু, মহানন্দার বুকে পচে যাওয়া জল সরিয়ে সাদা বালি বার করাতে কেউ উদ্যোগী হবেন না। শহরের ব্যস্ততম রাস্তা আটকে পার্কিং হটানোর ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি কারও তরফেই মিলবে না।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৫ ০২:৩০
Share:

এভাবেই জল নেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

আরও একটা ভোট! আবারও হইহল্লা চলবে। হবে অভিযোগের চাপানউতোর। ভোটের বাজারে নেতা-কর্মীদের একাংশের নানাবধি আশ্বাস, আস্ফালনও শুনতে হবে শহরবাসীকে।

Advertisement

কিন্তু, মহানন্দার বুকে পচে যাওয়া জল সরিয়ে সাদা বালি বার করাতে কেউ উদ্যোগী হবেন না। শহরের ব্যস্ততম রাস্তা আটকে পার্কিং হটানোর ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও প্রতিশ্রুতি কারও তরফেই মিলবে না। বিধান মার্কেটের অন্দরে রাস্তা জুড়ে দোকানের মালপত্র রাখার প্রবণতা আরও যাতে বাড়ে তা নিশ্চিত করবেন নেতাদের একাংশ। ক্রমশ শিলিগুড়ি যেন উত্তর পূর্ব ভারতের সবচেয়ে ঘিঞ্জি, যানজটে জেরবার শহর হিসেবে পরিগণিত হবে। এমনটাই ভাবছেন শহরের অনেকেই। অন্তত ভোটের প্রাক্কালে শহরের প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অনেকেরই আশঙ্কা, নেতাদের একাংশ ভোটে জিতে শহরের নাগরিক সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে লড়ছেন না। এমনকী, শহরের উন্নয়নের কথা বলে ফলাও করে প্রচার করলেও আসলে হয়তো অনেকের উদ্দেশ্য নিয়েই সংশয় রয়েছেন বিশিষ্ট শহরবাসীদের।

যেমন, শিলিগুড়ির কেন্দ্রস্থলের বাসিন্দা এক প্রবীণ আইনজীবী জানান, ভোটে জেতার পরের পাঁচ বছরে কোনও কোনও জয়ী প্রার্থীর সম্পদের পরিমাণ হু হু করে বাড়ে বলে অভিযোগ শুনি। বেকার যুবক ভোটে জেতার পরে পাঁচ বছরের মধ্যে কী ভাবে দু’টি গাড়ি, দু’টি ফ্ল্যাট, জমি-পুকুর কিনে ফেলেন সেই জাদুও জানতে ইচ্ছে হয় বলে রসিকতা করেন বর্ষীয়ান আইনজীবী। শহরের একজন প্রবীণ চিকিৎসক জানান, তিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে ‘প্র্যাকটিস’ করে যে সম্পত্তি করেছেন, সেটাই নাকি একজন পুরভোটে জিতে পাঁচ বছরে ছুঁয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

Advertisement

এই প্রসঙ্গেই প্রবীণদের অনেকে অতীতের শিলিগুড়ি পুরভোটের স্মৃতিচারণ করেছেন। কারও স্মৃতিতে উঠে এসেছে, কী ভাবে রাজস্থানী কায়দায় পাগড়ি বাঁধা এক দেহাতি ব্যক্তি সে সময় শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে সাফাইয়ের কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তার খোঁজখবর নিতেন। সে বার তিনিই বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে পুরভোটের দিনক্ষণ জানিয়েছিলেন। তখন পঞ্চাশের দশক। পুর পরিষেবা বলতে, বাড়ির পয়ঃপ্রণালী সাফাই আর সন্ধ্যেবেলায় হিলকার্ট রোডের ধারে কয়েকটি বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া। স্বাভাবিক ভাবেই সে সময়ের পুরভোটে শহরের বাসিন্দাদের ততটা আগ্রহ ছিল না বলে প্রবীণ-রা জানাচ্ছেন। ১৯৪৯ সালে শিলিগুড়ি পুরসভা গঠনের কয়েক বছর পরে প্রথম ভোট হয়। তবে পুরভোটে লড়াই লড়াই ভাব তৈরি হয় পঞ্চাশের দশকের শেষের দিক থেকে।

শহরের ইতিহাসচর্চায় যুক্তদের সৌজন্যে জানা গেল, অনেকটা বিজয়া করতে বের হওয়ার ঢঙে তখন ভোট প্রচার চলত। প্রবীণ বামপন্থী নেতা অধুনা ডানপন্থী দলে যোগ দেওয়া হরিসাধন ঘোষ স্মৃতি বললেন, “ভোট তখন উৎসবের মতো। প্রচার আছে, লড়াই আছে, কিন্তু তিক্ততা ছিল না। এত টাকাপয়সার লেনদেনের গল্প, অভিযোগও হতো না।” প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য মনে করেন, “তখন পুর কমিশনার বলা হতো। কমিশনাররা জিতেই টাকাপয়সার পেছনে ছুটতেন না। সেবামূলক মনোভাব ছিল। এখন তো মনে হয়, স্রেফ ‘টাকা কামাব’ মানসিকতা থেকে অনেকে ভোটে দাঁড়াতে মরিয়া। এটা দুর্ভাগ্যজনক।” শহরের আরেক প্রবীণ রাজনৈতিক শঙ্কর মালাকার মনে করেন, নয়া প্রজন্মের মধ্যে থেকে জনসেবামূলক মনোভাব এখনও পুরোপুরি উবে যায়নি। তাঁর কথায়, “তবে স্রেফ কামাই-ধান্দার জন্য যাঁরা ভোটে লড়েন, তাঁদের থেকে শহরবাসীর এবার পুরোপুরি মুখ ফিরিয়ে নেবেন। যাঁরা শহরের স্বার্থে কাজ করতে চান তাঁরাই জিতবেন।”

শিলিগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর তথা তৃণমূলের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কৃষ্ণ চন্দ্র পাল অবশ্য মনে করেন, বাম আমলে ২৮ বছর পুরসভায় কী হয়েছে, কংগ্রেসের দখলে থাকার সময়ে কতটা টাকা নয়ছয় হয়েছে তা শহরবাসী দেখেছেন। তিনি বলেন, “এবার শহরের মানুষ বেছে নেবেন তাঁদেরই, যাঁরা শহরকে গত কয়েক মাসের মধ্যে সাজার কাজ করেছে। শহরের ঝকঝকে রাস্তা, আলোই তার দৃষ্টান্ত। আগামী দিনে শহরের যাবতীয় পরিষেবার হাল ফেরাতে আমরা বদ্ধপরিকর।” নেতা-জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের কতটা ফারাক তা অতীতের শিলিগুড়ি দেখেছে। আগামী দিনে ওই ফারাক কতটা বাড়ে কিংবা কিছুটা কমে কি না সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায় শহরবাসী।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement