পরিবারের সঙ্গে শাহরুখ। নিজস্ব চিত্র
মোটে তো মাসতিনেক আগের কথা।
ইটভাটায় একটা কাজ পেয়েছিলাম। কবে হবে? সম্ভবত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। তিন মাস আগে মা ও ভাইকে নিয়ে বিহারের সাহুডাঙ্গি এলাকার সেই ইটভাটায় কাজ করতে যাই। এক মাস পর থেকে শুরু হল বিপর্যয়।
তখন তো জানতাম না লকডাউন কাকে বলে। তো শুরু হয়ে গেল সেই লকডাউন। চার দিকে সব বন্ধ। মালিকপক্ষ বলেছিলেন, লকডাউন উঠে গেলে কাজ শুরু হবে। কিন্তু ধাপে ধাপে তো লকডাউন বাড়তেই থাকে। আমাদের অভাবও বাড়তে থাকে।
এই অবস্থায় কত দিন চলবে? দ্বিতীয় লকডাউনের পর স্থির করি, বাড়ি ফিরতেই হবে এবার। এ দিকে, মালিকপক্ষ খাবারের টাকা দেওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে তখন। এক মাসের জমানো টাকায় কিছু দিনের খাওয়াদাওয়া চলেছিল। তা-ও শেষ।
এক রাতে কয়েক জন মিলে তাই বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। কী ভাবে ফিরব, রাস্তায় আটকে গেলে কী হবে, মা-ভাইকে নিয়ে বিপদে পড়তে হবে কি না, সে সবও ভাবতে হচ্ছিল। কিন্তু যে দিন হাতের পাঁচও শেষ হল, সে দিন সিদ্ধান্ত নিতেই হল। কারণ, আমার ছোট ভাই আছে, অনেকের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করত। আর সহ্য হচ্ছিল না। সব বাধাকে ঠেলে গত শনিবার রাতে বাড়ির উদ্দেশে বার হই।
আমার বাড়ি দিনহাটার ধাপরাহাটে। কারও কারও শীতলখুচি, সিতাই, মাথাভাঙায়। ইটভাটার যে গাড়িতে কাঁচা ইট পোড়াতে চিমনিতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটা নিয়েছি। তাতে প্রয়োজনীয় আসবাব, ভাই ও মাকে তুলে নিই। অনেকে সাইকেলে এসেছে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।
গভীর রাতে বেরিয়েছি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। পথে দিনের বেলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জল, শুকনো খাবার দিয়েছে। ১০০ কিমিরও বেশি রাস্তা দু-রাতে হেঁটে যখন শিলিগুড়ির ফুলবাড়িতে তখন সকলেই ক্লান্ত। পায়ে ফোস্কা পড়েছে আমার মতো অনেকেরই একই অবস্থা। সেখানে কয়েক জন ভাত দিয়েছেন। সেটা খেয়ে কিছুটা হলেও আরাম পেয়েছি।
ইচ্ছে ছিল, এবার ইদে টাকা উপার্জন করে বাড়ি ফিরব। পরিবারের সঙ্গে ইদের কয়েকটা দিন কাটাব। কিন্তু লকডাউনে সব যেন ওলটপালট হয়ে গেল। আমার আয়ে সংসার চলে। বাড়িতে দিদি, ছোট ভাই রয়েছে। তাদের কথা বারবার মনে করে মা আঁতকে উঠছেন। বাড়ি ফিরতে পারলে অল্প চাষের জমিতে তো চাষ শুরু করতে পারব। তা দিয়ে একবেলা খাবার তো জুটবে। সকলের সঙ্গে বাঁচতে পারব। না খেয়ে মরতে হলে সকলের সঙ্গে মরব, নিজের বাড়িতে।