রোচনা মজুমদারের ‘ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ’ (৪-১) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। শ্যাম বেনেগাল একাধিক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায়ের ছবির প্রতি তাঁর ঋণ এবং বিশেষ করে প্রথম বার পথের পাঁচালী দেখার অভিঘাতের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। তবুও লক্ষণীয়, তাঁর প্রথম ছবি থেকেই সিনেমার ক্যানভাসে ভারতীয় গ্রামজীবনকে যে ভাবে আমরা প্রতিফলিত হতে দেখি তা সত্যজিতের দেখা থেকে বহুলাংশেই ভিন্ন।
সত্যজিতের পথের পাঁচালীর কাব্যগুণের বিষয়ে অনেক আলোচনাই হয়। নিশ্চিন্দিপুরে অপুর গ্রামজীবন, কাশফুলের মধ্যে দিয়ে তার প্রথম রেলগাড়ি দেখার বিস্ময়, কিংবা দুর্গার চুল মেলে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যগুলির মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলার এক শাশ্বত মাধুর্যকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। আবহসঙ্গীতে রবিশঙ্করের সেতারের সঙ্গে সুব্রত মিত্রের ক্যামেরায় তোলা গ্রামজীবনের সাদাকালো চিত্ররূপ এবং তার সহজ সরল ছন্দ মিলে মিশে গিয়ে আমাদের মনে এক অদ্ভুত আবেগের তরঙ্গ সৃষ্টি হয়।
কিন্তু শ্যাম বেনেগাল প্রথম ছবি থেকেই কাব্যময়তা ও প্রাকৃতিক মাধুর্যের পরিবর্তে ত্রাস, শোষণ ও বৈষম্যের বীভৎসতা নিয়ে দর্শকের সামনে গ্রামজীবনকে হাজির করান। যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে সময় একই জায়গায় থমকে রয়েছে। সত্যজিতের অপু কলকাতায় পৌঁছে আধুনিকতার সংস্পর্শে আসতে পারলেও শ্যামের ছবিতে এই অগ্রগমনের তেমন চিহ্ন নেই। শ্যামের ছবিতে প্রকট হয় গ্রামজীবনের মধ্যে অন্তর্নিহিত শ্রেণি সংগ্রাম। স্পষ্ট হয়ে আসে পরিচালকের রাজনৈতিক চেতনা।
এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, প্রথম যুগের ছবি— অপু ট্রিলজি, তিন কন্যা ইত্যাদি পেরিয়ে পরের পর্বে এসে যখন সত্যজিৎ সদগতি (১৯৮১) নির্মাণ করলেন তখন ভারতীয় গ্রামের উগ্র জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতার যে নগ্ন রূপ দেখালেন, তা তাঁর প্রথম যুগের ছবির কাব্যিক মেজাজের সঙ্গে সে ভাবে মিলল না! আবহসঙ্গীতের অলঙ্করণও বহুলাংশে পরিহার করেন সত্যজিৎ। তার আগেই সত্তরের দশক জুড়ে শ্যাম তৈরি করে ফেলেছেন অঙ্কুর, নিশান্ত, মন্থন-এর মতো ছবি। কোথাও কি সত্যজিৎ তাঁর অনুজ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন?
সৌরনীল ঘোষ, কলকাতা-১৪১
অভাববোধ
সদ্যপ্রয়াত চলচ্চিত্রকার শ্যাম বেনেগালের স্মরণে রোচনা মজুমদারের ‘ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ’ প্রবন্ধ অত্যন্ত মূল্যবান। ‘মানুষের প্রতিরোধের ছবিকার’ রূপে মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও শ্যাম বেনেগাল ছাড়াও আরও কিছু সিনেমাশিল্পীর নাম মনে আসে। এঁরা ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায়ের সাক্ষী। তার সাক্ষ্য তাঁদের সৃষ্টির সময়কালে— মৃণাল সেন (১৯৫৯ থেকে ২০০২), সত্যজিৎ রায় (১৯৫৫ থেকে ১৯৯২), শ্যাম বেনেগাল (১৯৭৪ থেকে ২০২১), ঋত্বিক ঘটক (১৯৫৮ থেকে ১৯৭৬)। এই সময়ে ভারতীয় পর্দায় উঠে এসেছে উৎকৃষ্ট সব চলচ্চিত্র। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই পরিচালকদের নির্মিত চলচ্চিত্র প্রায় প্রত্যেকটি এক-একটি অমূল্য রতন। সেগুলি ফিল্ম স্কুলে পাঠ্য হওয়ার দাবি রাখে। তখনই প্রশ্ন আসে, ১৯৯০-২০২০, এই তিন দশক সেই তুলনায় নিষ্প্রভ কেন? বিগত তিন দশকে ‘মানুষের প্রতিরোধের ছবি’ সে ভাবে কেন তৈরি হচ্ছে না?
সভ্যতার পথে বৈপ্লবিক সৃষ্টিশীলতা সাধারণত জন্ম নেওয়ার কথা দ্বান্দ্বিক কারণে। অন্ধকার সময়ে এই দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক সকলেই এই দ্বন্দ্বকালেই সক্রিয়, তাঁরা অস্থির সময়ের সাক্ষী। শ্যাম বেনেগাল এই দ্বন্দ্বকালের শেষ পর্বের অন্যতম সাক্ষী। এঁদের প্রত্যেকের চলচ্চিত্রের ভাষা স্বতন্ত্র। শ্যাম বেনেগালের চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখক বেশ কিছু দ্বন্দ্বের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন নিম্নবর্ণের মানুষ, কৃষিজীবী ও নারীদের উপর অন্যায়-অবিচার ও সামন্ততান্ত্রিক নিপীড়ন, সময় ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সঙ্কট, ইতিহাস ও সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসের অভাব, নারী-স্বাধীনতা ও পুরুষতন্ত্র, সৃষ্টিশীলতা ও সামাজিক মর্যাদা, সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের টানাপড়েন ইত্যাদি। প্রতিটি দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
বিগত তিন দশকে এমন চলচ্চিত্রের অভাবের কারণ কী? চল্লিশের দশকের শেষ ভাগে সদ্য স্বাধীন ভারত এক আদর্শ দেশকাল ছিল এমন ব্যতিক্রমী বৈপ্লবিক চলচ্চিত্র নির্মাণ তথা জন্মের জন্য। কিন্তু স্বাধীনতা তো সোনার কাঠি ছিল না যা ১৯৪৭ সালে ছুঁইয়ে দিয়ে এক লহমায় জাদুমন্ত্রে দেশের গঠন ও চরিত্র বদলে যাবে। তার পর যত সময় এগিয়েছে দ্বন্দ্ব আরও জটিল হয়েছে। স্বদেশ, স্বাধীনতা, আধুনিকতা, আদর্শ, নীতিবোধ, সাংবিধানিক অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সমাজে ও জনমানসে প্রতি দিন নতুন নতুন সঙ্কট তৈরি হয়ে চলেছে। বস্তুত ভারতে অখণ্ডতা, মানবিকতা, পরিবেশ সচেতনতা, আন্তর্জাতিকতা,নাগরিকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক মাধ্যমে এখন আরও ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রের প্রয়োজন দেখা যাচ্ছে। বৃহত্তর ভারতের কথা না-ই বা ধরলাম, সামান্য কয়েক জন বাদে বাংলা চলচ্চিত্রও এই দিকটি নিয়ে ওয়াকিবহাল কি?
সত্তরের দশকে আমাদের মননকে সাংস্কৃতিক শিক্ষা দিতেই যেন এই ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্রকারেরা উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে পুণেতে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এফটিআই) তৈরি করেছে ভারত সরকার। সেই প্রতিষ্ঠানের এক ঝাঁক শিল্পী ভারতের চলচ্চিত্র জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৯৫ সালে কলকাতায় সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট তৈরি হয় যা বর্তমানে ভারত সরকারের প্রতিষ্ঠান। বেদনার কথা, কলকাতা এই প্রাপ্তি সত্ত্বেও তুলনায় কিছুটা নিষ্ফলা নয় কি? আমরা কি শুধুই কুর্নিশ করে যাব মাথা নিচু করে? মাথা উঁচু করে প্রতিরোধের ছবির চিহ্ন রেখে যেতে পারব না?
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি
মাইলফলক
রোচনা মজুমদারের লেখা ‘ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। শ্যাম বেনেগালের প্রথম দিকের ছবিগুলিতে (অঙ্কুর, নিশান্ত এবং মন্থন) ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে মানুষের বিদ্রোহের উন্মেষের মধ্যে নিহিত বিচ্ছিন্নতাকে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে শ্যাম বেনেগালের হায়দরাবাদে বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে তেলঙ্গানার কৃষক বিদ্রোহ তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে তাঁর গ্রামীণ শ্রেণির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপের সিদ্ধান্তের মধ্যে লুক্কায়িত বয়ঃসন্ধির সেই স্মৃতি। সেই কারণেই ছবিগুলি গ্রামীণ ভারতকে রোম্যান্টিক বা আদর্শবাদী আতশকাচে দেখার চেষ্টা করেনি। বাণিজ্যিক ছবির একরৈখিক নারী চরিত্রের বদলে এই ছবিগুলির মহিলা চরিত্ররা জটিল, সামাজিক গণ্ডির মধ্যে তাদের বিচরণও অন্য রকম।
হিন্দি ছবিতে নবতরঙ্গের জোয়ার থেকে ভাটা পর্যন্ত গতিপথে শ্যাম বেনেগালের এই ছবি তিনটি মাইলফলক হয়ে থেকে যাবে। ভারতের গ্রামজীবনে জাত, শ্রেণি এবং লিঙ্গ সংক্রান্ত সমস্যাগুলিতে সার্থক ভাবে আলোকপাত করেছিলেন তিনি।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
ইতিহাসনিষ্ঠ
অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের সারিতেই শ্যাম বেনেগালের নাম উচ্চারণ করেন। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দিই, সত্যজিৎ রায়ের মতো তিনিও অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন, তার পর সিনেমার জগতে আকাশ ছুঁয়েছেন। এবং ইতিহাসের প্রতি তাঁর বিশেষ নিষ্ঠার কারণে সাধারণ মানুষ ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিকে পর্দায় এত গ্রহণযোগ্য করে তুলেছেন।
দ্যুতিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-৪৭