তৃণমূল পরিচালিত দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট পুরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টি ওয়ার্ডেই আরএসপি প্রার্থী বিশ্বনাথ চৌধুরীর থেকে ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল প্রার্থী তথা বিদায়ী মন্ত্রী শঙ্কর চক্রবর্তী। শহরে বুথ ভিত্তিক প্রাপ্ত ভোটের এই হিসেব সামনে আসতেই দেখা গিয়েছে, তৃণমূলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিলরের ওয়ার্ডে হেরে গিয়েছেন শঙ্করবাবু।
শহর উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে এ বারে বালুরঘাটের ২৫টি ওয়ার্ড থেকে মন্ত্রী শঙ্করবাবু অন্তত প্রায় ৩ হাজার ভোটের লিড আশা করছিলেন। উল্টে সেখানে বিরোধী প্রার্থী বিশ্বনাথবাবু শহর থেকে প্রায় ২ হাজার ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছেন। বুথ ভিত্তিক এই ভোটের ফল পর্যালোচনা করে শহর থেকে শঙ্করবাবুর পিছিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছবিই দেখতে পাচ্ছেন দলের অনেকে।
বিশেষত পুরসভায় তৃণমূলের দখলে থাকা ১৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডে শঙ্করবাবুকে ছাপিয়ে বিরোধী বিশ্বনাথবাবু কি করে ১০০ থেকে ১৫০ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে গেলেন, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে অবিশ্বাস ও অন্তর্ঘাতের অভিযোগ তুলে পরস্পরের বিরুদ্ধে চলছে দোষারোপের পালা। পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান রাজেন শীল বলেন, ‘‘কেন এমন হলো, তা খতিয়ে দেখে দলকে জানানো হবে।’’
পুরসভার প্রয়াত চেয়ারপার্সন চয়নিকা লাহার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ২০৯ ভোট, ভাইস চেয়ারম্যান রাজেন শীলের ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৫৯ ভোট এবং তৃণমূল কাউন্সিলার বাপি রুদ্রের ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৫৬ ভোটের লিড আশাপূরণ করেছে বিদায়ী মন্ত্রী শঙ্করবাবুর। কিন্তু চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল তথা পুরসভার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা দলের মহিলা কাউন্সিলারের ১০ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ১৫৩ ভোটের লিড পেয়েছেন বিরোধী প্রার্থী বিশ্বনাথবাবু। তৃণমূলের ১নম্বর ওয়ার্ডে ৭৩ ভোট, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৭১ ভোট, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫০ ভোট, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ২২৫ ভোটের লিড দলের প্রার্থী শঙ্কর চক্রবর্তীর বদলে বাম প্রার্থী বিশ্বনাথ চৌধুরীর ঘরে চলে গিয়েছে। এতেই সন্দেহ দানা বাঁধছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে উল্টো কাজ করে শঙ্করবাবুর ভোট কাটা হয়েছে বলে শঙ্কর-বিরোধী কয়েকজন নেতা আড়ালে স্বীকার করেছেন।
রাস্তা চওড়া করা, ফুটপাতে লোহার রেলিং দেওয়া, সেতু তৈরি করা থেকে শহরের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করে জয় নিয়ে একরকম নিশ্চিত ছিলেন শঙ্করবাবু। একসময়ের তাঁর মূল ভোট ম্যানেজার, শহরের যুব তৃণমূল নেতা দেবাশিস মজুমদার থেকে শুরু করে গতবারের ভোট-সেনাপতিদের এবার ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে বলে অভিযোগ।
বিপ্লব মিত্রের অনুগামী বলে পরিচিত দেবাশিসবাবুদের মতে, বালুরঘাটের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তথা তৃণমূলের জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রবীর রায় থেকে ব্লক নেতা বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের মতো নেতাদেরও শঙ্করবাবু ডাকেননি বলে অভিযোগ। হিলিতে তো প্রকাশ্যে শঙ্কর বিরোধীতায় নেমে বিরুদ্ধ প্রচারের অভিযোগ উঠেছে ডিপিএসসির চেয়ারম্যান কল্যাণ কুণ্ডু, হিলির ব্লক সভাপতি আশুতোষ সাহাদের বিরুদ্ধে। ফলে বসে যাওয়া অনেক নেতাকে প্রচারে মাঠে নামালে সরাসরি শঙ্করবাবুর বিরুদ্ধে যাওয়াটা আটকানো যেত, তা এখন অনেকে মেনে নিচ্ছেন। তা না হওয়ায় উল্টো কাজ করার সুযোগ পেয়ে অনেক শঙ্করবাবুর ভোট কেটে সাফ করে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য হিলির নেতা কল্যাণবাবু, আশুতোষবাবুরা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘ভোটের কাজে শঙ্করবাবুর ডাকেননি। কিন্তু কোনও বিরোধিতা করা হয়নি।’’
বালুরঘাট ব্লকের অমৃতখন্ড অঞ্চলে যেখানে শঙ্করবাবুর লিড নিশ্চিত ছিল, সেখানেও আরএসপির বিশ্বনাথবাবু উল্টে ১০৮ ভোট বেশি পেয়েছেন। তৃণমূলের দখলে থাকা ওই অঞ্চলগুলির মতো একইভাবে হিলি ব্লকের বিনশিরা, ধলপাড়া, পাঞ্জুল, জামালপুর এবং হিলি অঞ্চলে গড়ে ৫০০ থেকে ১২০০ ভোটের লিড পেয়ে শঙ্করবাবুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন বিশ্বনাথবাবু।
তৃণমূল পরিচালিত বালুরঘাটের চিঙ্গিশপুর অঞ্চলে শঙ্করবাবুর কমপক্ষে ৩ হাজার ভোটের লিড পাওয়ার কথা ছিল। গত লোকসভাতেও ওই অঞ্চল থেকে তৃণমূলের সাংসদ প্রায় ৬ হাজার ভোট লিড পেয়েছিলেন। গোষ্ঠীকোন্দল সক্রিয় হয়ে শঙ্করবাবুর লিড কমিয়ে চিঙ্গিশপুরে মাত্র ৯৪৭ ভোটে তার বিজয় রথ থামিয়ে দিয়েছে। তাতেই বালুরঘাট কেন্দ্র থেকে মাত্র ১৪৫০ ভোটের ব্যবধানে জিত হাসিল করে নিয়েছেন বিশ্বনাথ চৌধুরী।