ফাইল চিত্র।
রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দেখা হল এক অভিভাবকের সঙ্গে। তাঁর সন্তান প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। অভিভাবক জানতে চাইলেন, ‘‘স্কুল কবে খুলবে, স্যর? মেয়েটা কিছুই পড়তে পারছে না। মুখ ভার করে বসে তাকে। আমাদেরও অভাব। গৃহশিক্ষক দিতে পারি না।’’ তার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘‘যা শিখেছিল, ছুটি বেড়ে যাওয়ায় সে সবও ভুলতে বসেছে।’’
বলতে পারলাম না যে, ক্লাসে আসতে বলুন, পড়াব। কারণ, ক্লাসঘরে তালা। সেই নির্দেশ অমান্য করলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। তবু আশ্বাস দিলাম পাশে থাকার।
গরমের ছুটি ৪৫ থেকে আরও ১১ দিন বাড়িয়েছে রাজ্য শিক্ষা দফতর। খুব চিন্তা হয় সেই পড়ুয়াদের জন্য, যারা বাড়ির কাজ সেরে কিংবা পরিবারকে মাঠের কাজে সাহায্য করে সপ্তাহে ৩-৪ দিন স্কুলে যেত কিছু শেখার জন্য। যার বাবা নেই, মা কষ্ট করে স্কুল নির্ভর পড়াশোনা করাচ্ছিলেন, কিংবা যে মেয়েটির বিয়ের প্রস্তুতির মোকাবিলায় পড়ার জেদ করে বসে আছে। তার কাছে হার মানছে পরিবার। আর পঞ্চম শ্রেণির অভাবী ঘরের সেই ছোট্ট ছেলেটির কথা মনে পড়ছে, যে এক বেলা মিড ডে মিলের জন্য রোজ স্কুলে যেত। পড়তএবং শিখত।
এই পড়ুয়াদের জন্য আমি ক্লাসে ফিরতে চাই। গত দু’বছরে এমন কিছু পড়ুয়ার আর স্কুলে ফেরা হয়নি। তাদের কেউ চায়ের দোকানে কাজ করছে, বাজারে আনাজ বিক্রি করছে, কেউ বা ভিন্ রাজ্যে কচি হাতে টানছে গরম রড। আমি এমন ঘরের পড়ুয়াদের আর স্কুলছুট হতে দিতে চাই না। এখনও রোজ স্কুলে যাই। কিন্তু ধুলো জমে থাকা তালা দেখে মনটা কেঁদে ওঠে। চুপ করে থাকি।
ক্লাসঘরের আত্মীয়তা, পাঠ্য বই আর প্রশ্ন-উত্তরের টান আমায় স্কুলমুখী করে। কোনও পড়ুয়া বুঝতে না পারলে তাকে কয়েকবার বোঝানো, আবার কেউ টানা ২-৩ দিন স্কুলে না গেলে সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া— এ সব যেন অতীত। করোনার পরেও সেই দিনগুলি ফেরা হল না।
আজও কয়েক জন অভিভাবক ফোন করে জানালেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়া ফেলে মোবাইলে বা খেলায় মত্ত। স্কুল খুললে ইউনিট টেস্ট নেওয়া কথা ছিল। তা-ও হল না। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কী যে হবে!
লেখক স্কুলের প্রধান শিক্ষক
অনুলিখন: নীতেশ বর্মণ