— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
দক্ষিণবঙ্গের নিশ্চিত ‘রিজ়ার্ভেশন’ পেতে হলে হাতে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ চাই। এমনই একটি কথা চালু রয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রশাসনে। দক্ষিণবঙ্গের ‘রিজ়ার্ভেশন’ মানে সেখানকার হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকদের বদলির নিশ্চয়তা। এবং ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ মানে অন্তত পনেরো লক্ষ টাকা ‘দক্ষিণা’। উত্তরবঙ্গে কর্মরত দক্ষিণবঙ্গের চিকিৎসকেরা অনেকেই বাড়ির কাছাকাছি বদলির অপেক্ষা করেন। আবেদন করলে অথবা সরকারি নিয়মে তা সম্ভব। যদিও বর্তমানে অন্তত পনেরো লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য দফতরে কয়েকজন কর্তার নির্দেশে ‘এজেন্টদের’ কাছে পৌঁছে না দিলে বদলি সম্ভব নয়। যদিও চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, পনেরো লক্ষ টাকা দিলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই। অন্য কেউ যদি কুড়ি লক্ষ টাকা দিয়ে দিতে পারে, তা হলে ‘টিকিট’ তার। এই চক্রের নিয়ন্ত্রকও ‘উত্তরবঙ্গ লবি’, অভিযোগ চিকিৎসকদের। আর জি কর কাণ্ডের পরে অবৈধ বদলির বিষয় নিয়েও স্টেট ভিজিল্যান্স কমিশনে অভিযোগ করেছেন ওয়েস্টবেঙ্গল হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের এক কর্তা।
স্বাস্থ-প্রশাসন অন্দরের খবর, এই ‘লবির’ আশীর্বাদে পছন্দের জায়গায় বদলি হওয়া যায়। আবার ‘লবির’ রোষে পড়লে সমস্যা। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কিছু অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এক স্বাস্থ্যকর্মীকে বাঁকুড়ায় বদলি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। গত বছর সেই স্বাস্থ্যকর্মীকে ফের জলপাইগুড়িতে বদলি করা হয়। সূত্রের দাবি, ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ চোখ এড়িয়েছিল সে বদলি। ২০২৩ সালের মে মাসে সেই কর্মী জলপাইগুড়িতে কাজে যোগ দেওয়ার মিনিটখানেকের মাথায় সরকারি বদলির নির্দেশ আসে।
আর জি কর-কাণ্ডের পরে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে দুর্নীতির যে সব অভিযোগ উঠছে, তার একটি দিক অবৈধ বদলি বা চিকিৎসক, স্বাস্থ্য আধিকারিকদের ‘ট্রান্সফার’ ঘিরে। অভিযোগ, ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ বিরাগভাজন হওয়ায় যেমন বিভিন্ন জায়গায় কলকাতা থেকে চিকিৎসকদের বদলি করা হয়েছে, তেমনই টাকার বিনিময়ে অনেককে পছন্দের জায়গায় বদলি করানো হয়েছে। স্বাস্থ্য-প্রশাসনে ‘উত্তরবঙ্গ লবির’ বিরোধী চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য আধিকারিকদের একাংশ জানান, গত বছর ‘লবির’ রোষে পড়ায় এসএসকেএম-এর এক নেফ্রোলজিস্টকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে বদলি করা হয়। তাতে ওই হাসপাতালে নেফ্রোলজির ‘পোস্ট ডক্টরাল কোর্স’ করানোয় সমস্যা হয় শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাবে।
মেডিসিনের এক চিকিৎসককে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল থেকে জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে বদলি করা হয়। আর জি কর থেকে রেডিওথেরাপির এক চিকিৎসককে রায়গঞ্জ মেডিক্যালে পাঠানো হয়। যেখানে রেডিওথেরাপি বিভাগের পরিকাঠামোই নেই বলে অভিযোগ। একই ভাবে ফরেনসিক বিভাগের এক নোডাল অফিসারকে আরজি কর থেকে বাঁকুড়াতে পাঠানো হয়।
অভিযোগ, ১৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পছন্দের ‘পোস্টিং’ পাওয়া যেত। উত্তরবঙ্গে এই ‘লবির’ মাথায় কোভিডের সময়ে জনস্বাস্থ্য দফতরের ‘ওএসডি’ পদে থাকা সুশান্ত রায় রয়েছেন বলে অভিযোগ। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত এই ‘লবি’র অন্যতম সদস্য তথা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের প্রাক্তনী এক চিকিৎসক। অভিযোগ, তাঁর মাধ্যমেই বদলির বিষয়গুলো পাঠানো হত স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর পদমর্যাদায় থাকা এক মহিলা আধিকারিকের কাছে। তিনি এখন সে পদে নেই। সম্প্রতি ‘লবির’ এক চিকিৎসক আর জি কর থেকে কোচবিহারে বদলির নির্দেশ পান। দু’বার বদলির নির্দেশ হয়েছিল আর জি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষেরও। তা রদ করে দেওয়া হয়।
সুশান্ত রায় অবশ্য বলেন, ‘‘ভিত্তিহীন। যা খুশি অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সমস্ত বদলি স্বাস্থ্য ভবন থেকেই পদ্ধতি মেনে হয়।’’ তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, বদলি পছন্দ না হলে অভিযোগ তোলা বরাবরের রীতি।
(চলবে)