শিখ ধর্মের প্রভাব রবীন্দ্র-মানসে প্রায় অপরিজ্ঞাত, তাই পরিচিত রবীন্দ্রনাথের অপরিচিত এই শিখ যোগসূত্রই উঠে এল ‘গুরুদেবের গুরুনানক’ অনুষ্ঠানে। ভাবনা ও পরিচালনায় অংশুমান পাল। ত্রিশোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেই সূত্র। মানসী গীতিকাব্য ৩১-৩৪ বছরের মধ্যে লেখা হলেও শিখ গুরুদ্বার ও গুরু নানকের সঙ্গে গুরুদেবের প্রথম সংযোগ ঘটে ১৮৭৪-এ, যখন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি অমৃতসর পৌঁছন, বয়স তাঁর বারো। শিলিগুড়ির সেবক রোডে গুরুদ্বারে রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষে গানে, কবিতায়, কথোপকথনে আয়োজিত হল এই জন্মবাসর। সূচনা হয় গুরুনানক রচিত ভজনে ‘গগন মে থাল, রবি চন্দা দীপক বানে’ দিয়ে। (এই গানটিই আরতি প্রার্থনায় পরিবেশিত হতে দেখেন দেবেন্দ্রনাথ, পরবর্তীতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটির প্রথমাংশ বাংলায় অনুবাদ করেন)। ‘জীবনস্মৃতি’র প্রথম পাণ্ডুলিপি থেকে কিশোর রবির অমৃতসর বাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। গুরুদ্বারের সভাপতি গুরুচরণ সিংহ হোরা বলেন, ‘‘গুরুদ্বারে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবারই প্রবেশাধিকার আছে।’ অনুষ্ঠানে স্বাতী চৌধুরী ও শম্পা ঘোষ গাইলেন ‘তোমরা সবাই ভাল’ ও ‘এ মোহ আবরণ খোলো’ রবীন্দ্রগানগুলি। অমিতাভ কাঞ্জিলালের কণ্ঠে নিষ্ফল উপহার, শেষ শিক্ষা, গুরু গোবিন্দ, রবীন্দ্র কবিতাগুলির আবৃত্তি শোনা এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। গুরুনানকের জীবনকথা সহজ সরল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘কাজের লোক কে?’ প্রবন্ধে। ‘বীর গুরু’ প্রবন্ধটিতে পাই দশম ও শেষ গুরু গোবিন্দ সিংহের জীবন বর্ণনা সূত্রে ধর্মপ্রাণ শিখজাতির বীর জাতিতে পরিণত হওয়ার ইতিহাস। অধ্যাপক সুবোধকুমার যশের আলোচনায় উঠে এল এমন সব তথ্য। প্রসঙ্গ সূত্রে জানালেন রবীন্দ্রনাথের ‘শিখ স্বাধীনতা’ প্রবন্ধটিতে বালক পত্রিকায় প্রকাশের জন্য লেখা হলেও ভারতীয় জাতীয়তাবোধের অন্যতম দিক নির্দেশ রয়েছে এই রবীন্দ্র রচনাটিতে। গুরুনানক যে সঙ্গীতের দ্বারা আধ্যাত্মিক দর্শনের প্রবর্তন করেন, যার ভিত্তিতে মহর্ষি ব্রাহ্মমন্দিরে ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়ার প্রচলন করেন, সেই ভাবনাকে ঘিরেই ধ্বনিত হল সঙ্গীতা পালের বেহালায় ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’। শিখ ধর্ম ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলেন এই প্রজন্মের অদ্রিজা দত্ত। শিখদের প্রদর্শিত পথেই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয় বুলূবুল বোসের এসরাজে ‘একটি নমস্কারে প্রভু’-র মাধ্যমে ‘মাথা ছোঁয়ানোর’ মধ্যে দিয়ে। শিখ ধর্মের অনুষঙ্গে রবীন্দ্র-সংযোগের এই অনুষ্ঠানটির আয়োজক শিলিগুড়ির একটি বৈদ্যুতিন মাধ্যম।