পিরের ঘোড়া
পিরের ঘোড়ার হাত ধরে উত্তর দিনাজপুরের হাটপা়ড়া গ্রামের কুনোর পরিচিতি আদায় করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে। গোটা দিনাজপুরেই ছ়ড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পিরের মাজার, চলতি কথায় পিরের থান। কী হ্নিদু কী মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই এই পিরের থানে মাটির ঘোড়া উৎসর্গ করার চল রয়েছে। অন্নপ্রাশন, বিয়ে, নবান্নের সময় এমনকী গরুর বাচ্চা প্রসব করলেও পিরের থানে পুজো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মাটির ঘোড়া চড়ানোর রীতি রয়েছে। গাধার মতো ঘোড়াগুলির উচ্চতা হয় ৬ থেকে ৮ ইঞ্চির মতো। তবে কারওর মানত থাকলে বড় আকারের ঘোড়া দেবারও প্রথা রয়েছে। এ ছাড়া বৈশাখ মাসের শুক্রবার ঘোড়া চড়ানোর রেওয়াজ আছে। এই সব রীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ইতিহাস আশ্রিত জনশ্রুতি। বখতিয়ার খিলজি দিনাজপুরের দেবকোট দখল করে বঙ্গে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ধ্বংস করেন দেবকোটের হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ স্তূপগুলি। বঙ্গ বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে দিনাজপুরের হিন্দু মৃৎশিল্পীদের নির্দেশ দেন ঘোড়া তৈরি করতে। মৃৎশিল্পীরা রাজি হলেন না। বখতিয়ারের ঘোড়া তৈরির এই আদেশ জারি হলে রাজ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। কেউ রাজ্য ছেড়ে চলে যান অসম, বাংলাদেশে। বখতিয়ার হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সমন্বয়ের জন্য কাজে লাগান উদার ভাবধারার সাধকদের। পিরের ঘোড়া পিরের ঘোড়া দুটি ধর্মের সংশ্লেষিত প্রতীক। সুফি সাধকদের কারণেই বখতিয়ারের যুদ্ধবিজয়ের স্মারক ঘোড়া পরবর্তীতে পির দরবেশদের সম্মান জানানোর প্রতীক হয়ে উঠল। কুশের এলাকার প্রায় শ’খানেক পরিবার জড়িয়ে রয়েছে এই শিল্পটির সঙ্গে। পরিবারের পুরুষ-নারী সবাই এই কাজে হাত লাগান। কিছু পরিবার বংশপরম্পরা ধরে এ কাজ করে চলেছেন। বাজার বলতে ধনকোল ও কুমোরের হাট। বাইরের বহু মানুষ ঘর সাজানোর জন্য পিরের ঘোড়া কিনে নিয়ে যান। কিন্তু কেউই শিল্পীদের দুর্দশার কারণ শুনতে চান না। দুলাল রায়, লালমোহন রায়, জবা রায়দের কথায়, গ্রামে ঢোকার রাস্তাটি বর্ষায় জলকাদায় ভর্তি হয়ে যায়। হাঁটাচলা দায় হয়। নেই গুদাম ঘর বা স্থায়ী ভাটিঘর। তাই চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আষাঢ় থেকে আশ্বিনে কাজ কমে যায়। অন্য সময় মাসে হাজারখানেক ঘোড়া বানাতে হয়। বর্ষার সময় অর্ধেকেরও কম।
কবি স্মরণে
পেশায় শিক্ষক প্রয়াত কবি সুজিত অধিকারী কবিতাচর্চা শুরু করেন নব্বই দশকের শেষাশেষি। চাকরি সূত্রে উত্তর দিনাজপুরে থাকাকালীন সম্পাদনা করতেন লিটল ম্যাগাজিন ‘নৈশ্চিক’। প্রচারের আলোকের বাইরে থেকে কবিতাচর্চায় নিবিষ্ট করেছিলেন নিজেকে। তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘ডাহুকের পাখশাট’, ‘পুড়ানি ধানের শীষ’, এবং ‘কাশফুলের ক্লাসরুম’। তাঁর প্রয়াণের পর তিনটি কাব্যগ্রন্থ দুই মলাটে বন্দি করে প্রকাশিত হয় কাব্যগ্রন্থ ‘ডাউন ট্রেনের কামরায়’। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয় তাঁর আরও একটি কাব্যগ্রন্থ ‘পুনর্জন্ম অথবা গান’ আকস্মিক প্রকাশ ঘটে ২০১৪-র ২৫ জুলাই। প্রয়াত কবির জীবন ও কাব্যজগৎ নিয়ে সম্প্রতি একটি আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হল ধূপগুড়ির ডাউকিমারির ডি এন হাইস্কুল কক্ষে। আয়োজক নৈশ্চিক অকাদেমি। উদ্বোধক রানা সরকার জানালেন কবির বেদনায় ও মায়াময় কাব্যজগতে উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। তাঁর কাব্য নিয়ে চর্চা করার সময় এসেছে। ‘আমাকে গুপ্ত হত্যার আগে ফুল দাও’ এ রকম কবিতার লাইন পাঠ করতে গিয়ে পাঠক হিসেবে ঘোর লাগে। তাঁর সৃজিত কাব্য পাঠ করতে করতে কুহকের ভিতর প্রবেশ করি। প্রসঙ্গ সূত্রে বললেন, ‘মল্লার’এর সম্পাদক শুভময় সরকার। কবির রচিত ‘খবর’ এবং ‘বার্তা’ কবিতা দুটি পাঠ করেন ‘মধ্যবর্তী’ পত্রিকার সম্পাদক বিশ্বরূপ দে সরকার। গৌতম কুমার ভাদুড়ির কথায়, কবি সুজিত অধিকারী যা লিখেছেন তা স্মরণয়োগ্য। পাঠক তাকে বহু দিন মনে রাখবে। কবি সুবীর সরকারের মতে, কবি সুজিতের লেখায় রয়েছে এই প্রান্তিক ভূগোলের কবিকেন্দ্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। এখন কবিতাচর্চা হচ্ছে প্রান্ত থেকেই। ছিল স্থানীয় কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠ। সূচনা সঙ্গীতটি গান সংহিতা অধিকারী। সভামুখ্য ছিলেন কবি পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত।
রবি অর্ঘ্য
কোচবিহার থেকে প্রকাশিত ‘প্রান্তিক’ পত্রিকার (সম্পাদক দেবব্রত দে সরকার) উদ্যোগে বিগত কয়েক বছর ধরে রবীন্দ্র ভাবনায়, রবীন্দ্র চেতনায় প্রকাশিত হয়ে চলেছে রবি অর্ঘ্য (ফোল্ডার)। তাদের সপ্তম বর্ষ নবম সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটল রণজিৎ দেবের হাত ধরে। সভামুখ্য ছিলেন দিগ্বিজয় দে সরকার। ফোল্ডারটিতে স্থান পেয়েছে দিব্যেন্দু ভৌমিকের প্রবন্ধ ‘জোড়াসাঁকোর অন্দরমহল ও সারদাসুন্দরী দেবী’ এবং দিগ্বিজয় দে সরকারের যে ধ্রুপদ ‘দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে’ প্রবন্ধটি। রয়েছে আটটি কবিতা। কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কবিদের ব্যক্তিগত উপলব্ধির পাশাপাশি ডুয়ার্সের সৌন্দর্যের কথা এবং বাস্তববাদী ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। লেখক-গবেষক নৃপেন্দ্র নাথ পাল জানান, কোচবিহারের বহু লেখক আছেন যাদের লেখা, কবিতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়নি, যার আশু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সহজপাঠ থেকে শেষের কবিতা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জীবনে কী ভাবে জড়িয়ে আছেন তা নিয়েই মানস চক্রবর্তী পাঠ করেন তার মৌলিক রচনা ‘শেষ কথা’। স্থানীয় কবিদের মধ্যে কবিতাপাঠে অংশ নেন মাধবী দাস, পাপড়ি গুহ নিয়োগী, সমীর কুমার দাস, প্রবীর কুণ্ডু প্রমুখ। রবীন্দ্রগানে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন উর্ভি ব্রহ্মচারী।—অনিতা দত্ত
জলছাপ
‘‘তারিখ বদলায় হুহু করে পেরিয়ে যায় দিন। শুধু কিছু কিছু কথা থেকে যায়’’। সেই সব কথায় লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল দেওয়াল পত্রিকা ‘জলছাপ’ (সম্পাদনা: শাঁওলি দে)। বহু বর্ণের সেই ‘দেওয়াল’-এ আঁকা হয় প্লাবনের ছবি— ‘উঠোনে ঘোর বর্ষা/রুহ ভেঙে ভাঙছে জল, ভাঙছে বাঁধ/ নদীতে উঠেছে বান।’ দেওয়ালে ঝলসে ওঠে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব—‘মনখারাপের পাশ কাটিয়ে/ আমার শ্রেষ্ঠটুকু তোমাকে দিলাম। কখনও সেখানে ছায়া পড়ে গভীর বিষণ্ণ কথার-তোমাদের গল্পে আমি কোথাও নেই/এখন পৃথিবীর গভীরতম অসুখ। এমন সব নিজস্ব কথামালায় কোচবিহার-হলদিবাড়ির এই ‘দেওয়াল’ সাজিয়েছেন ২৫ জন কবি। দারুণ সুন্দর সেই ‘দেওয়াল’-এর অলংকরণ করেছেন আজাদ হোসেন।
শিক্ষার্থীর ধর্ম হয় না
বিদ্যা বিকিকিনির বাণিজ্যিক সময়ে তিনি নিঃশর্ত বিদ্যাদান করে চলেছেন। মোহনবাটী পার্বতীদেবী বালিকা বিদ্যালয় (রায়গঞ্জ)-এর ইংরেজি শিক্ষিকা ঊষা ভৌমিক। এমন মহান ব্রত কেন? ‘‘নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ির সামর্থ্য ছিল না পড়াশোনার খরচ বহন করার। সে সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন চঞ্চলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর ধর, সত্যেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং পরবর্তী সময়ে সুনীল সরকারের মতো ঈশ্বরতুল্য শিক্ষকেরা। বিদ্যাদান করতে তাঁরাই শিখিয়েছিলেন। বিদ্যা দান করে গুরুদক্ষিণা দিচ্ছি।’’ তাঁর কাছে ছাত্রছাত্রীদের একটাই ধর্ম— শিক্ষার্থী। তাই সাঁওতাল বা মুসলিম ছাত্রীদের বাড়িতে স্থান দিয়ে শিক্ষাদান করেন। কখনও শিক্ষক, কখনও মাতৃস্নেহে তাদের পাশে দাঁড়ান। ১৯৮৭ থেকে এ ভাবে তৈরি করেছেন বহু কৃতী ছাত্রী। কেউ জোর করে গুরুদক্ষিণা দিলে সেই অর্থ খরচ করেছেন পড়ুয়াদের জন্যই। তিনি বলেন, ‘‘পড়ুয়াদের নিজের স্কুল বা অন্য স্কুলের বলে কখনও ভাবিনি। বিদ্যাদান করার আনন্দ অন্য কিছুতে পাই না।’’ তাঁর নেশা বই পড়া। মিডিয়ার চেয়ে বইয়ের অবদান বেশি বলে মনে করেন। অবসরের বেশি দেরি নেই। তখনও কি বিদ্যাদান করবেন? বললেন, ‘‘আমৃত্যু। আমার শিক্ষকদের গুরুদক্ষিণা দিতেই হবে। না হলে ঋণী থেকে যাব। তাঁর বিদ্যালয় জীবন একদিন সমাপ্ত হবে। নাকি সূচনা হবে একটি নতুন ঊষাকালের?
—সুদীপ দত্ত