ছবি: সংগৃহীত।
একজনের আড়াই বছরের সন্তান পড়ে রয়েছে প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটার দূরে, কলকাতায়। অন্যজনের দেড় বছরের সন্তান রয়ে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে, রায়গঞ্জে। আর এদের দুই মায়েরা এখন করোনার বিরুদ্ধে দিনরাত এক করে লড়াই করে যাচ্ছেন আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে। সন্তানের সঙ্গে দুই মায়েরই দেখা নেই প্রায় দু-মাস! বুকে পাথর চাপা দিয়ে তাঁরা নির্বিবাদে ডিউটি করে যাচ্ছেন। শুধু রাতে বা সকালের দিকে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে কোনওমতে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন দুই মা। তাঁদের দেখে অভিভূত হাসপাতালের সহকর্মীরা।
পুষ্পিতা ঘোষ এই হাসপাতালে ডেপুটি নার্সিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট। কলকাতা লাগোয়া সোদপুরের বাসিন্দা পুষ্পিতা গত ফেব্রুয়ারিতে হাওড়ার একটি হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে এখানে যোগ দেন। অন্যজন অর্পিতা গঙ্গোপাধ্যায় একই হাসপাতালের নার্সিং ইনচার্জ। রায়গঞ্জের বাসিন্দা অর্পিতা বছরখানেক ধরে এই হাসপাতালে আছেন। তখন থেকেই দেড় বছর ও ছয় বছর বয়সের দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে আলিপুরদুয়ারে একটি ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন তিনি। বড়ছেলেকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করেন তিনি। তাঁর স্বামী কৌশিক দত্ত রায়গঞ্জেই ব্যবসা করলেও, নিয়মিত আলিপুরদুয়ারে যাতায়াত করেন।
অর্পিতার বড়ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর গত ১৭ মার্চ তাঁর দুই সন্তানই বাবার সঙ্গে দিনকয়েকের জন্য রায়গঞ্জের বাড়িতে গিয়েছিল। কিন্তু তারা আলিপুরদুয়ারে মায়ের কাছে ফেরার আগেই শুরু হয় লকডাউন। ফলে দুই সন্তানই আটকে পড়ে রায়গঞ্জে, আর মা আলিপুরদুয়ারে। অর্পিতার কথায়, “দুই ছেলেকে ছাড়া এতদিন কখনও একা থাকিনি। কী যে কষ্টে রয়েছি বলে বোঝাতে পারব না। ওদের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ফোনে ভিডিয়ো কল। প্রতিদিন ডিউটি থেকে বাড়ি ফিরে ওদের সঙ্গে কথা বলি। এটুকুই যা।”
অর্পিতার সহকর্মী পুষ্পিতা অবশ্য এখানে একাই থাকছিলেন। তাঁর আড়াই বছরের শিশুপুত্র সোদপুরে বাবা ও দাদু-দিদিমার সঙ্গেই থাকছিল। পুষ্পিতার কথায়, “প্রতি মাসে অন্তত একবার করে বাড়ি গিয়ে ছেলেকে দেখে আসব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু গত ১৪ মার্চ আলিপুরদুয়ারে ফেরার পর আর যেতে পারিনি। এখন প্রতিদিন ভিডিয়ো কল করেই ছেলের সঙ্গে কথা বলছি। ওকে ভিডিয়ো কল করলেই সিংহের গল্প শুনতে চায়। ওকে ভুলিয়ে রাখতে তাই কাজের মাঝেই নতুন নতুন সিংহের গল্প তৈরি করি!” ডেপুটি নার্সিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে সারি ওয়ার্ড সামলানোর পাশাপাশি তপসিখাতা করোনার সারি হাসপাতালে কে কবে ডিউটিতে যাবেন তার সবটাই দেখতে হচ্ছে পুষ্পিতাকে। অন্যদিকে রোটেশন অনুযায়ী আগামী ১৮ মে থেকে তপসিখাতার হাসপাতালে ডিউটির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্পিতাও।
আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের সুপার চিন্ময় বর্মণ বলেন, “করোনার বিরুদ্ধে আমাদের হাসপাতালের চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অনেককেই নিজেদের আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে। তাঁদের জন্য আমরা গর্বিত।”