গণেশ মহন্ত। নিজস্ব চিত্র।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্দুক নিয়ে খান সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি। ডান পায়ের হাঁটুতে এখনও স্পষ্ট গুলির দাগ। কাঁধে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দিনহাটার পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সেই গণেশ মহন্ত। পেটের টানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষা করেন তিনি। বার্ধক্য ভাতা ছাড়া প্রশাসন থেকে কখনও কোনও সহায়তা পাননি। নেই নিজের কোনও অর্থবিত্তও। ফলে বৃদ্ধ বয়সে অশক্ত শরীরে ভিক্ষাই সম্বল প্রাক্তন এই সেনার।
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তখন সে টগবগে যুবক। মাঝে পেরিয়ে গিয়েছে ৫০ টি বছর। এখন বয়স তাঁর নব্বইয়ের কোঠায়। অশক্ত শরীরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিনহাটার পথেঘাটে ঘুরে বেড়ান তিনি। সরকারি সাহায্য বলতে শুধু বার্ধক্য ভাতা পান। টিনের একটি ছোট ঘর। সেখানেই থাকেন গণেশ ও তাঁর স্ত্রী শ্যামলী। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে দিনহাটা এক নম্বর ব্লকের বড়শোলমারী গ্রাম পঞ্চায়েতের এই মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ এখন আর কেউ রাখেন না।
বড়শোলমারী গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বিউটি বর্মণ রায় বলেছেন, ‘‘গণেশ মহন্ত যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা জানা ছিল না। অবশ্যই খোঁজখবর নিয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব।’’ মহকুমা শাসক হিমাদ্রি সরকারের আশ্বাস, ‘‘অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়ে প্রশাসনিকভাবে ওঁকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করব।’’
কেমন ছিল একাত্তরের সেই দিনগুলি? গণেশ বর্ণনা করেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আঁচ তখন এ পার বাংলাতেও আছড়ে পড়েছে। মাতৃভূমির মুক্তির জন্য সে দিন তিনি সীমান্ত পেরিয়ে দিনহাটায় আসেন রাইফেল ট্রেনিং নিতে। দিনহাটার ফুলদিঘীর পাড়ে তখন পালা করে সাত দিন করে প্রশিক্ষন হত। প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা কয়েক জন ওপারে গিয়ে যুদ্ধ করেছেন। সেই সময় খানসেনা আর রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমে শত্রুপক্ষের গুলি তাঁর পায়ে লাগে। গুরুতর আহত আহত হন তিনি । ডান পায়ের হাঁটুতে সেই গুলির ক্ষত আজও রয়েছে।
রক্তঝরা সেই দিনগুলির কথা গিয়ে আবেগতাড়িত বৃদ্ধ। বলেছেন, ‘‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসে। এই সাগরেই মিশে আছে তাঁরও এক ফোঁটা রক্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু কে আর খোঁজ রাখে তাঁর মত হতভাগ্যের।’’ বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও জন্মভূমির মায়া ছেড়ে সীমান্ত পার করে এ পারে এসে তাঁরা বসবাস শুরু দিনহাটার বড়শোলমারি এলাকায়। ঈষৎ ক্ষোভ আর মনের ব্যথা নিয়ে সংসার শুরু করেন গণেশ। স্ত্রী শ্যামলী মহন্ত জানান, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার বছর তিনেক পরে পরিচয় হয় তাঁদের।
গণেশ জানিয়েছেন, অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহকুমার অন্তর্গত সাহাদুল্লাপুর থানার রসুলপুর ইউনিয়নে গণেশ মহন্ত জন্ম। স্থানীয় নলডাঙ্গা হাইস্কুলে তাঁর লেখাপড়া। সপ্তম শ্রেণী পাশ করার পরে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের আর্থিক কারণে ছোটবেলাতেই শুরু করতে হয় কাজ। তিন ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার গড়লেও ঘরে-বাইরে এখন একাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। বার্ধক্য ভাতা ছাড়া আর কিছুই মেলে না। জবকার্ড থাকলেও এখন সুবিধা মেলে না। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি আর রেশনের উপর ভরসা করে জীবনের বাকি দিনগুলি বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে কাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রাক্তন এই যোদ্ধা। এক যুদ্ধ শেষ হলেও জীবনের যুদ্ধ এখনও লড়তে হচ্ছে তাঁকে।