মাল মহকুমার মৌলানিতে একটি চা বাগানে, গত বুধবার। ফাইল চিত্র
শ্বাপদ হিসেবে নিঃশব্দে শিকারে তাদের জুড়ি নেই। অথচ সেই চিতাবাঘই এখন শিকার হয়ে যাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পাহাড়-সমতলের বনাঞ্চলের অলিখিত পরিসংখ্যান যেন সে কথাই বলছে। তাই বন দফতরের দুশ্চিন্তাও বেড়ে গিয়েছে। গত এক মাসের মধ্যে উত্তরবঙ্গের সমতল এলাকাতেই ৪টি চিতাবাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। লোকালয়ে ঢুকে পড়া চিতাবাঘের মৃত্যুর পরে কোথাও সুকৌশলে চাউর হয়ে যাচ্ছে, দু’টি পুরুষ চিতাবাঘের মধ্যে এলাকা কিংবা সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ের জেরে মৃত্যু হয়েছে।
বন দফতর সূত্রের খবর, প্রতি ক্ষেত্রেই দেহাংশ বাজেয়াপ্ত করে গবেষণাগারে নমুনা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, রিপোর্ট কবে আসবে তার কোনও ঠিক নেই। ফলে, বন দফতর কোনও ঝুঁকি না নিয়ে চিতাবাঘের মৃত্যু রুখতে প্রতিটি বনাঞ্চল ও চা বাগান লাগোয়া এলাকায় নজরদারি ও সচেতনতা বাড়ানোর কাজে জোর দিয়েছে।
উত্তরবঙ্গের বন্যপ্রাণ বিভাগের মুখ্য বনপাল উজ্জ্বল ঘোষ বলেছেন, ‘‘পরপর চিতাবাঘের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক। তাই প্রতিটি এলাকায় বিশেষ টিম তৈরি হয়েছে। চিতাবাঘকে রেডিও কলার পরানোও শুরু হয়েছে।’’
গত শুক্রবার নাগরাকাটার গাঠিয়া চা বাগান থেকে একটি জখম চিতাবাঘকে উদ্ধার করেন বনকর্মীরা। গরুমারার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে সেটিকে আনা হয় চিকিৎসার জন্য। শনিবার সকালে চিতাবাঘটির মৃত্যু হয়েছে। বন দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে চিতাবাঘটির সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। সেটিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলেই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে এলাকায়।
চিতাবাঘ-বৃত্তান্ত
• চিতাবাঘ (লেপার্ড)
• প্রজাতি বিড়াল
• বৈজ্ঞানিক নাম প্যান্থেরা পারডাস
• আবাস উত্তরবঙ্গে সব বন ও চা বাগান লাগোয়া জঙ্গলে বিচরণ। পাহাড়ে, গাছে চড়তে ওস্তাদ
• সংখ্যা উত্তরবঙ্গে চিতাবাঘ প্রায় ৫০০
• আকার পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘের দৈর্ঘ্য ৭ ফুট অবধি হয়। লেজের দৈর্ঘ্য ৩ ফুটও হতে পারে
• ওজন পুরুষ চিতাবাঘের ওজন ৫৫ কেজি অবধি হতে পারে। মাদি চিতাবাঘের ওজন ৩০ ৬০ অবধি হয়
• কেন বিপন্ন বিচরণ ক্ষেত্র দখল করছে মানুষ। শিকারের অভাবে লোকালয়ে হানা দিতে বাধ্য হচ্ছে। চোরা শিকারিরা চামড়া, দেহাংশের লোভে চিতাবাঘ মারছে
• আশঙ্কা কোথায় গত ৫ বছরে উত্তরবঙ্গের চা বলয়, বনাঞ্চল লাগোয়া এলাকা ও কয়েকটি গ্রামীণ এলাকায় বিষক্রিয়ায়, পিটিয়ে, গুলি করে অন্তত ৩০টি চিতাবাঘের মৃত্যু হয়েছে
• আশঙ্কা গত এক মাসে অন্তত ৪টি চিতাবাঘের দেহ মিলেছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায়। ঘটনায় চিন্তিত পরিবেশপ্রেমীরা।
গত সপ্তাহে শিলিগুড়ির নকশালবাড়ির চা বাগান লাগোয়া এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে চিতাবাঘের দেহাংশ। গত জানুয়ারিতে গরুমারার কাছে উদ্ধার হয়েছিল আরও একটি চিতাবাঘের দেহ। তার নখও উপরে ফেলা হয়েছিল। পরপর এমন ঘটনায় উদ্বেগে পশুপ্রেমীরা। কে বা কারা কেন এই সব খুন করছে, তা নিয়ে নানা পাল্টা মতামতও রয়েছে।
পশুপ্রেমীদের একাংশ বলছেন, এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো। জঙ্গল ছোট করে বসতি বাড়ছে। ফলে শুধু চিতাবাঘই নয়, সব পশুরই বিচরণ ক্ষেত্র, খাবার কমছে। তারা ঢুকে পড়ছে লাগোয়া লোকালয়ে। এতে তিতিবিরক্ত এলাকার বাসিন্দারা। হাতির মতো বড় মাপের পশুকে সামলানো কঠিন। তবে চিতাবাঘকে ঘিরে ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা একেবারেই আশ্চর্যের নয়।
যদিও এই তত্ত্ব মানতে চান না অনেকেই। তাঁদের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গ জুড়েই বন্য প্রাণীদের দেহাংশ পাচার চক্র সক্রিয় হয়েছে। ইদানীং উত্তরের বনাঞ্চলগুলির চিতাবাঘও সেই চক্রেরই থাবার নীচে।
(চলবে)