এ যেন জনপ্রিয় সিনেমা ‘বাহুবলী’র কপি কাট! যেখানে রাজার সুবিশাল মূর্তি স্থাপন করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর উপক্রম হয় শ্রমিকদের। বাস্তবে নাকি তেমনই ঘটছে আরব মুলুকে। মূর্তির বদলে সমুদ্র উপকূল বরাবর লম্বা রাস্তার মতো এলাকা জুড়ে স্মার্ট সিটি তৈরি করছেন সেখানকার যুবরাজ। আর সেই প্রকল্পেই নাকি মৃত্যু হচ্ছে হাজার হাজার ভারতীয়ের।
চলতি বছরের অক্টোবরে সৌদি আরবের মেগা প্রকল্প ‘দ্য লাইন’কে কেন্দ্র করে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ করে আইটিভি। ‘কিংডম আনকভারড: ইনসাইড সৌদি আরাবিয়া’ নামের সেই তথ্যচিত্র দুনিয়া জুড়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে। সেখানে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত ২১ হাজার বিদেশি শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে।
তথ্যচিত্রে আইটিভি জানিয়েছে, নিহত শ্রমিকদের অধিকাংশই ভারত, বাংলাদেশ এবং নেপালের বাসিন্দা। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্পটিতে কর্মরত শ্রমিকদের দিনে ১৬ ঘণ্টা করে খাটানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছে তারা। যদিও সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছে মক্কা-মদিনার দেশ।
তথ্যচিত্রে আরও বলা হয়েছে, দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে বেশি পরিমাণে পরিযায়ী শ্রমিক এই প্রকল্পে নিয়োগ করা হচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দ্য লাইনের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছেন সৌদি প্রধানমন্ত্রী তথা যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন অল সৌদ। ফলে খারাপ পরিবেশে জীবনকে বাজি রেখে দ্রুত গতিতে চলছে নির্মাণকাজ।
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছে সৌদি আরবের ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ’। একটি বিবৃতিতে এই সরকারি সংস্থা জানিয়েছে, ‘‘দ্য লাইন প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু সংক্রান্ত ভুল তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। ভিত্তিহীন পরিসংখ্যান দিয়ে অযথা ভয়ের পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত চলছে। এটি একেবারই কাম্য নয়।’’
সৌদি সরকারের দাবি, আরব মুলুকটিতে যে কোনও নির্মাণ প্রকল্পে শ্রমিকদের মৃত্যুর পরিমাণ প্রতি এক লক্ষে ১.১২ জন। যা সারা দুনিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। তা সত্ত্বেও কেন দ্য লাইনকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তা নিয়ে তদন্তের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সলমন প্রশাসন।
বিবৃতি দিয়ে দেশটির জাতীয় পেশাগত নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কাউন্সিল বলেছে, ‘‘মানব সমাজের মঙ্গলকামনায় আমরা ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকল্প শুরু করেছি। এতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের মৃতদেহের উপর সৌদি কোনও দিন কোনও নির্মাণকাজ চালায়নি। আর আগামী দিনেও সেটা চালাবে না।’’
সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনের স্বপ্নের প্রকল্প হল দ্য লাইন। যাতে লোহিত সাগরের তীর থেকে তাবুক প্রদেশের নিয়ম পর্যন্ত লম্বাটে রাস্তার মতো এলাকায় স্মার্ট সিটি তৈরি করবে রিয়াধ প্রশাসন। একটি মাত্র বাড়ির মধ্যে গোটা শহরটি থাকবে বলে প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্য লাইন প্রকল্পের জন্য জলের মতো টাকা খরচ করছে সৌদি প্রশাসন। এতে মোট ব্যয়ের অঙ্ক এক লক্ষ কোটি ডলার ধার্য করা হয়েছে। আস্ত একটা শহর গড়ে তুলতে ১৭০ কিলোমিটার লম্বা যে বাড়িটি তৈরি করা হচ্ছে, তাতে থাকবে ৫০০ মিটার উচ্চতার কাচের কাঠামো। সেখানে ব্যবহৃত হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি। থাকবে না কোনও গাড়ি।
২০৩০ সালের মধ্যে দ্য লাইন পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেলে প্রাথমিক ভাবে সেখানে ৯০ লক্ষ সৌদিবাসী বসবাস করতে পারবেন। এর মধ্যে থাকবে উচ্চ গতির রেলপথ। দৈনন্দিন বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা মেটাতে এটি ব্যবহার করবেন সেখানকার বাসিন্দারা।
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, এই প্রকল্প তৈরিতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আরব মুলুকটির ইঞ্জিনিয়ারেরা। যার জেরে কিছুটা থমকেছে নির্মাণকাজ। এ ছাড়া মূল বাজেটের সঙ্গে বর্তমানে তৈরির খরচের মিল না থাকায় প্রকল্পের কাজ পিছোতে কিছুটা বাধ্য হয়েছে সৌদি প্রশাসন।
সংবাদ সংস্থা ‘রয়টার্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে ‘ভিশন ২০৩০’র মধ্যে দ্য লাইন প্রকল্প শুরু করেছেন সৌদি যুবরাজ সলমন। এ বছরের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে নির্মাণকাজে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা এক লক্ষ ৪০ হাজার বলে জানা গিয়েছে। এই আবহে হঠাৎ করে বিদেশি শ্রমিক মৃত্যুর খবর তথ্যচিত্র মারফত প্রকাশ্যে আসায় রিয়াধের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সৌদি আরবের নিয়ম অনুযায়ী, এই ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ভাবে স্বাস্থ্য বিমা থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, অত্যধিক গরমের সময়ে তাঁদের দিয়ে কাজ না করানোর কথাও বলা হয়েছে। আইটিভির তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার জেরে একটা বড় অংশের বিদেশি শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
রিয়াধ অবশ্য বলেছে, ‘‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন) এবং সৌদি আরবের নিয়ম মেনে ঠিকাদার সংস্থাগুলি দ্য লাইন প্রকল্পে কাজ করছে কি না, তার উপর নজর রাখা হচ্ছে। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জীবন ও কাজের পরিবেশ সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও কেন এই অভিযোগ উঠছে তা বুঝতে পারছি না।’’
যুবরাজ সলমনের স্বপ্নের প্রকল্পে একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার কাজ করার খবর মিলেছে। যার মধ্যে জেকব্স, এইকম, বিচটেল, কেলার, উইবিল্ট, এজিস, টার্নার অ্যান্ড টাউনসেন্ড, আর্চিরোদন এবং ডেমে উল্লেখ্যযোগ্য। নির্দিষ্ট একটি ঠিকাদার সংস্থার শ্রমিকেরা নিহত হয়েছেন কি না, তা তথ্যচিত্রে উল্লেখ করা হয়নি।
এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন দাস-বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠনের এক পদস্থ কর্তা। তিনি বলেছেন, ‘‘সৌদি আরব রাজপরিবারের দাস ব্যবহার করার পুরনো ইতিহাস রয়েছে। টাকার লোভে এই প্রকল্পে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল বা আফ্রিকার বাসিন্দাদের কাজ করানো খুব অস্বাভাবিক নয়। তবে একুশ শতকে অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। আর তাই এ ব্যাপারে প্রমাণ ছাড়া কিছুই বলা যাবে না।’’
লোহিত সাগরের তীর থেকে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে এই সুবিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করছে সৌদি প্রশাসন। ফলে সেখানে নির্মাণকাজ চালানো এমনিতেই চ্যালেঞ্জের। যার জেরে শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়টিকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞেরা। আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের মুখরক্ষা করতে সলমন প্রশাসন মৃতদেহ লোপাট করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একাংশ আবার এই ব্যাপারে ভারত-সৌদি সম্পর্কে চিড় ধরার বিষয়টিও সামনে এনেছেন। তবে এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে নয়াদিল্লির তরফে রিয়াধকে সরকারি ভাবে কোনও বার্তা দেওয়া হয়নি।