পরাজিত বিদায়ী চেয়ারম্যান বিভূতি ঘোষ। ছবি: মনোজ মুখোপাধ্যায়।
নির্বাচনের দিন বিকেলেই পুরাতন মালদহের ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি বশিষ্ঠ ত্রিবেদী বলেছিলেন, লিখে রাখুন, পুরাতন মালদহে তৃণমূল একক ভাবে জিততে পারবে না। বোর্ড ত্রিশঙ্কু হবে। পুরাতন মালদহের পুরসভা ভোটের ফলাফল জানার পরে বশিষ্ঠবাবুর মুখে চওড়া হাসি।
এই পুরসভা তাঁর কথা মতোই ত্রিশঙ্কু হয়েছে। তবে তার থেকেও বেশি খুশির খবর হল, তৃণমূলের বিদায়ী চেয়ারম্যান বিভূতি ঘোষ হেরে গিয়েছেন। বশিষ্ঠবাবু তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে নির্দল হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি জিতেছেন।
বিদায়ী চেয়ারম্যানকে হারাতে শুধু তৃণমূলের একাংশ বা বিক্ষুব্ধরাই নন, কার্যত মহাজোট হয়েছিল ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে একমাত্র নির্দল প্রার্থী পরিতোষ ঘোষকেই সমর্থন করেছিলেন বাকিরা। বিভূতিবাবু মহাজোটের নির্দল প্রার্থীর কাছে হেরেছেন ৩৫৮ ভোটে। বিভূতিবাবু পেয়েছেন ১২৫৫টি ভোট আর পরিতোষবাবু পেয়েছেন ১৬১৩টি ভোট।
নির্বাচনের দিনই অবশ্য অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন বিভূতিবাবু। দিনভর দাঁড়িয়েওছিলেন বুথের সামনে। এদিনও গণনা কেন্দ্রে ঢোকার সময় মুখে ছিল হাসি। আশা একটা ছিল, শাসকদলের প্রার্থী হওয়ার সৌজন্যে যদি কোনও অঘটন ঘটে যায়। কিন্তু খানিকবাদেই বুঝে যান এ যাত্রায় মহাজোটের উদ্দেশ্য সফল। তার পরেই বাইরে বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়েন। আর বিরোধীরা তো বটেই, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল ছাড়াও তৃণমূলের একাংশকেও প্রকাশেই বলতে শোনা গিয়েছে, ‘বোর্ড যাই হোক চেয়ারম্যানকে তো বধ করা গিয়েছে।’ ফলাফলের উপরে চোখ বোলাতে বোলাতে বিভূতিবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘মানুষের রায় মাথা পেতে নিতেই হবে। তবে দল খুব একটা খারাপ ফল করেনি। ওয়ার্ডের বিদায়ী সিপিএম কাউন্সিলার লিপিকা ঘোষের স্বামী এবার প্রার্থী ছিলেন। মানুষ তার উপরেই আস্থা রেখেছে।’’
পুরাতন মালদহে ২০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ২০টি, বিজেপি ৫টি, সিপিএম ২টি ও নির্দল ৩টি আসন পেয়েছে। আগের নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে এককভাবে জিতে বোর্ড গঠন করেছিল। কিন্তু এবার ওই পুরসভা থেকে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। ২০টি ওয়ার্ডের মধ্যে আটটি ওয়ার্ডে তো কংগ্রেস প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট একশোরও নীচে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভূতিবাবু সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় বোর্ড তৃণমূলের দখলে চলে যায়। কিন্তু পুরভোটের প্রার্থীপদ নিয়ে তৃণমূলে কোন্দল শুরু হয়। নিজের পরিবারের লোকজনদের প্রার্থী করার অভিযোগ ওঠে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। তারপরেই পাঁচটি ওয়ার্ডে নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়ে পড়েন বিক্ষুব্ধরা। আর তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিদায়ী চেয়ারম্যানকে হারানোর চেষ্টা। তৃণমূল ছেড়ে নির্দল হিসাবে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তাদের মধ্যে বশিষ্ঠবাবু ছাড়াও সফিকুল ইসলাম ওরফে নেপুও জয়ী হয়েছেন। নেপু তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি ছিলেন।
বোর্ড ত্রিশঙ্কু হওয়ার পিছনে দলের ওই দ্বন্দ্বই কাজ করেছে বলে মনে করছে বিরোধীরাও। যদিও ত্রিশঙ্কু হলেও তারাই যে ওই পুরসভায় বোর্ড গঠন করবেন, তা এদিন সাফ করে জানিয়েছেন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। কিন্তু কীভাবে বোর্ড গঠন করবে তৃণমূল? তাহলে কি দল ছেড়ে যাওয়া নির্দলদের ফের দলে টেনে নিয়ে আসা হবে? কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘তাস খেলায় টেক্কাটা আস্তিনে গুটিয়ে রাখা হয়, সময় হলে আস্তিন থেকে টেক্কা দিয়ে বাজিমাত করা হয়।’’ সেই টেক্কা কি দুই জয়ী দুই নির্দল? কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘সময়ই সে কথা বলবে।’’
বিদায়ী চেয়ারম্যান তো হেরেছেন। তাহলে কি ফের তৃণমূলে ফিরবেন বশিষ্ঠবাবু! তিনি যে টেক্কা হয়ে উঠতে পারেন, এতটা নিজেও ভাবেননি তিনি। এদিন তিনি বলেন, ‘‘সবে তো ফল প্রকাশ হল। কী করব এখনও ভাবিনি। ওয়ার্ডের যারা আমাকে জিতিয়েছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই স্থির করব।’’ একই কথা বলেছেন সফিকুল ইসলামও।
বিভুতিবাবু বলেন, ‘‘এই পুরসভায় বিরোধীরা আমাদের বিরুদ্ধে অলিখিত জোট করেছিল। তবুও আমরা অর্ধেক আসন পেয়েছি। আর মানুষের রায় আমরা মেনে নিয়েছি। বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে নির্দলদের সাহায্য নেওয়া হবে কি না, তা দলই ঠিক করবে।’’ বশিষ্ঠবাবু বলেন, ‘‘মানুষ পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। আমাদের এই জয় মানুষের জয়। আমরা কোন দিকে যাব তা মানুষই ঠিক করবেন। তবে বলতে পারি, বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে আমরা নির্দলরা বড় ফ্যাক্টর।’’
এই পুরসভায় বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার উৎসাহিত নেতৃত্ব। ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী বিজেপির সৌমেন সরকার বলেন, ‘‘এখানে আমারা শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। এবার আমরা পাঁচটি পেয়েছি। আশা করি আগামীতে পুরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে পদ্ম ফুল ফুটবে।’’
বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি হলেও পুরসভা থেকে মুছে গেল কংগ্রেস। ছয় থেকে শূন্য হয়ে যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন কংগ্রেসের জেলা সভাপতি তথা সংসদ মৌসম নুর। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ভোট কেন কমল তা বুথ স্তরের কর্মীদের নিয়ে আলোচনা করা হবে।’’
কংগ্রেসের মতো আসন সংখ্যা কমেছে বামেদেরও। পুরসভার প্রক্তন চেয়ারম্যান বামফ্রন্টের বিশ্বনাথ শুকুল বলেন, ‘‘আমাদের আসন সংখ্যা কমেছে ঠিকই। কী কারণে এমন হল, তা আমরা দলীয় পর্যায়ে আলোচনা করব।’’