মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবেদন অজয় এডওয়ার্ডের।
এক বছরও হয়নি দলটার জন্ম হয়েছে। নতুন দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে পাহাড়ের রাজনীতি তো বটেই, রাজ্য-রাজনীতিতেও সাড়া ফেলেছে হামরো পার্টি। গত পুরভোটে দার্জিলিং পুরসভা দখল করার পর জিটিএ নির্বাচনে লড়েও প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে তারা। সেই অজয় এডওয়ার্ডের দলই এ বার ভাঙনের মুখে। জল্পনা তৈরি হয়েছে ছটপুজোর পরেই দার্জিলিং শহর লাগোয়া ঘুম জোড়বাংলো কেন্দ্রের জিটিএ সদস্য প্রোমোসকর ব্লোন এবং পুলবাজার বিজনবাড়ির কেন্দ্রের ভূপেন্দ্র ছেত্রী দল ছাড়তে চলেছেন। যা নিয়ে সরগরম পাহাড়ের রাজনীতি। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অজয়। রাজ্যের শাসক দলের দুই শীর্ষ নেতার কাছে তাঁর আবেদন, ‘দল ভাঙানোর খেলা’ বন্ধ হোক পাহাড়ে!
দলের সম্ভাব্য ভাঙনের খবর স্বীকার করে গত মঙ্গলবার প্রোমোসকর এবং ভূপেন্দ্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেছেন অজয়। তাঁর অভিযোগ, জিটিএ নির্বাচনের পর থেকে পাহাড়ে ‘স্বৈরতন্ত্র’ চালাচ্ছেন প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার নেতা অনীত থাপা। বিরোধী দল ভাঙিয়ে কণ্ঠরোধের চেষ্টা হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিরোধী দলের চাপেই প্রশাসন ভাল কাজ করতে বাধ্য হয়। ৩০-৩৫ বছর পর পাহাড়ে গণতন্ত্র স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু অনীতরা স্বৈরতন্ত্র চাইছেন। এটা হতে পারে না।’’ মমতা এবং অভিষেকের উদ্দেশে অজয় বলেন, ‘‘এ ভাবে দল ভাঙার রাজনীতি ঠিক নয়। আপনাদের কাছে অনুরোধ, এটা দয়া করে দেখুন৷ বহু বছর পর পাহাড়ে গণতন্ত্র ফিরেছে। বিরোধী দল হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হব, এটাই আমাদের কাজ। আবারও ডিক্টেটরশিপে (একনায়কতন্ত্র) চলে যাচ্ছে পাহাড়।’’
তবে দল ভাঙানোর অভিযোগ স্বীকার করেননি অনীত। তিনি আগেই বলেছেন, ‘‘আমি নেতিবাচক রাজনীতি করি না।’’ তবে দলের এক শীর্ষ নেতার দাবি, ক্ষমতায় থেকে উন্নয়নের কাজে সুবিধা হবে ভেবে, অনেকে বিরোধী দল ছাড়তে চাইছেন।
এ প্রসঙ্গে জিটিএ সভাসদ তথা পাহাড়ের তৃণমূল নেতা বিনয় তামাং বলেন, ‘‘শুনেছি, হামরো পার্টির দু’জন অনীতের দলে যোগ দিচ্ছেন। অজয় নিজেই ফেসবুক লাইভে সে কথা জানিয়েছেন। তবে এখনই আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানানো হয়নি।’’ দার্জিলিং জেলা তৃণমূলের সভাপতি (পাহাড়) শান্তা ছেত্রীও বলেন, ‘‘কে কোন দলে থাকবেন, সেটা তাঁদের বিষয়। এবং সংশ্লিষ্ট দল কী পদক্ষেপ করবে, সেটাও ওই দলের ব্যাপার। তবে বিরোধী দলকে মান্যতা দেওয়া উচিত শাসক দলের।’’
বছর তিনেক আগে জিএনএলএফ থেকেই একসঙ্গে পথ চলা শুরু হয়েছিল অজয় এবং প্রোমোসকরের। পাহাড়ের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরাও জানাচ্ছেন, দু’জনের মধ্যে বহু দিনের সম্পর্ক। একসঙ্গে তাঁরা সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্মও করেছেন। সেই সূত্রেই জিএনএলএফ থেকে বেরিয়ে তাঁরা হামরো পার্টি গড়েন। ওই দলের এক নেতার কথায়, ‘‘দু’জনে একে অপরের পরিপূরক। দল শুরুর প্রথম দিন থেকে অজয় পর্দার আড়ালে ছিলেন। সামনে থেকে কাজ করেছেন প্রোমোসকরই।’’ সেই অজয় আর প্রোমোসকরের সম্পর্কে এমন ‘দূরত্ব’ দলের অনেক নেতাই ভাল চোখে দেখছেন না। অজয়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘অনীতরা স্বৈরতন্ত্র চাইছে। প্রোমোসকর ছাড়াও আমার দলের অনেক নেতাকে ওঁরা টোপ দিয়েছে। গোপন বৈঠকও করেছে কখনও বিজন বাড়িতে, কখনও শিলিগুড়িতে। আমি প্রোমোসকরকে ফোন করেছি। মেসেজ করেছি। কিন্তু উনি আমার কথার কোনও জবাব দেননি।’’ সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে প্রোমোসকরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও বলেছেন অজয়।
প্রোমোসকরের পাল্টা অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে কোনও কথা না বলে বৈঠক না করেই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁকে এবং ভূপেন্দ্রকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর সঙ্গে অনীতদের কোনও গোপন বৈঠক হয়নি জানিয়ে প্রোমোসকর বলেন, ‘‘দলটা ফেসবুককেন্দ্রিক নয়। লাইভে এসে অজয় আমাকে ও ভূপেন্দ্র ছেত্রীকে বহিষ্কারের কথা বলেছেন। কোনও বৈঠক ডাকা হয়নি। বৈঠক ডেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। জিটিএ-তে বিরোধী শক্তি হিসেবে আমাদের সঙ্গে অনীতের দেখা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। অজয়ের সঙ্গেও তো দেখা হয়। সেটা নিয়ে তো আমরা প্রশ্ন তুলি না। আমার সঙ্গে অনীতের কোনও গোপন বৈঠক হয়নি।’’
যদিও অজয় জানান, তিনি মোটেই প্রোমোসকর আর ভূপেন্দ্রকে দল থেকে বহিষ্কারের কথা বলেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মাঝে হায়দরাবাদ আর রাজস্থানে গিয়েছিলাম। তার মধ্যে এত কিছু ঘটে গিয়েছে। আমি প্রোমোসকরের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করতে পারিনি। ওঁকে নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমাকে সেন্ট্রাল কমিটির বৈঠক ডাকতে হবে। প্রোমোসকর আমাদের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওঁকে এ ভাবে বার করে দেওয়া যাবে না। তাই সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেছি। দল থেকে বহিষ্কারের কথা বলিনি।’’
পাশাপাশিই, অজয় হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, দুই সদস্য দল ছাড়ার ঘোষণা করলেই অনুগামীদের নিয়ে ধর্নায় বসে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালন করা হবে। এই পরিস্থিতিতে কি সত্যিই অনীতের দলে যোগ দিতে চলেছেন প্রোমোসকরেরা? বিক্ষুব্ধ নেতা বলেন, ‘‘আমি এখনও ইস্তফা দিইনি। যদিও আর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অজয় বহিষ্কার করে দেওয়ার কথা বলেছেন। তবে এটা প্রমাণিত যে, দলে অজয়ের স্বৈরতন্ত্র চলছে। আমি নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলব। জানতে চাইব, তাঁরা কী চান। তার পর সব জানাব। ভূপেন্দ্রও একই কাজ করবেন।’’