তখন ঠিকানা পিলখানা। মাহুত জগনু ওঁরাওয়ের সঙ্গে ফুলমতি। নিজস্ব চিত্র।
জঙ্গল ওকে বরাবরই টানে। গভীর অরণ্যের দিকে তাকিয়ে মাঝেমাঝেই আনমোনাই হয়ে থাকত সে। প্রতিদিনই সঙ্গীদের সঙ্গে জঙ্গলে গিয়ে ফিরে আসার সময় পেছন ফিরেও মাঝে মধ্যে চেয়ে থাকত। কিন্তু গত শনিবার সেই অরণ্যের টানটা এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে আর কোন পিছুটান বাগ মানল না। পিঠ থেকে মাহুতকে ফেলে জঙ্গলেই চলে গেল সে। গরুমারা জাতীয় উদ্যানের মেদলার পিলখানার কুনকি হাতি ফুলমতি গত শনিবার মাহুতকে ফেলে দিয়ে জঙ্গলে চলে যায়। এরপর থেকেই অন্যান্য কুনকি হাতি দিয়ে বনকর্মীরা ফুলমতিকে ফেরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে চললেও ফিরে আসার কোনই লক্ষণ দেখাচ্ছে না ফুলমতি। বনকর্মীরা জানাচ্ছেন জলঢাকা, মূর্তি আর ডায়না নদীর মিলনস্থলে যে বিরাট ঘাসজমি রয়েছে সেখানেই দিনকয়েক ধরে বড় একটি হাতির দল রয়েছে। সেই দলে দাঁতাল, মাকনার মতো বেশ কিছু ষন্ডাগন্ডা পুরুষ হাতিরা রয়েছে। যুবতী ফুলমতি সেই অমোঘ টানকে আর অস্বীকার করতে না পেরেই ওই দলটিতেই গিয়ে ভিড়েছে। আর ওই বড় হাতির দলটিও ওকে বেশ আপন করেই নিয়েছে বলেই জানাচ্ছেন বনকর্মীরা। এক বনকর্মীর কথায়, ‘‘ফুলমতির পায়ে বেড়ি রয়েছে। দূর থেকেই আমরা আমরা ওর উপরে নজর রাখছি, দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ খোশমেজাজেই রয়েছে।’’ জলপাইগুড়ির গরুমারা বন্যপ্রাণ বিভাগের ডিএফও উমা রানি অবশ্য বললেন ফুলমতি খুব শীঘ্রই ফের পিলখানায় ফিরে আসবে। বনকর্মীরা ওকে ফেরানোর সব রকম চেষ্টাই করে চলেছেন।
উল্লেখ্য পিলখানা থেকে এই ফুলমতির পালিয়ে যাওয়া এই প্রথমবার নয়। তিন বছর আগে ২০১৩তেও ফুলমতি পালিয়ে গিয়েছিল। মেলায় তাঁবু খাটিয়ে ছোট সার্কাসে খেলা দেখাবার কাজ করত এই ফুলমতি। গত ২০০৩এ অসম থেকে বিহারে এরকমই একটি মেলায় যাবার পথে জলপাইগুড়ির তিস্তা চেকপোস্টে মালিকপক্ষ ফুলমতির বৈধ কাগজ দেখাতে না পারায় রাজ্য বনদফতর ফুলমতিকে বাজেয়াপ্ত করে গরুমারায় পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অসমের পৃথক ঘরানায় প্রশিক্ষণ শেখা ফুলমতির জন্যে পুরানো মাহুত জগনু ওঁরাওকেই ফুলমতির মাহুত হিসাবে রেখে দেয় বনদফতর। কিন্তু এ দিন দীর্ঘদিনের মাহুত জগনুকেই পিঠ থেকে ফেলে পালিয়ে যায় ফুলমতি।
শনিবারেও ফুলমতির সঙ্গে কিরণরাজ, মেঘলালরাও জঙ্গলে পাতা সংগ্রহের কাজে গিয়েছিল। ওদের সামনে থেকেই পলাতক হয় ফুলমতি। ২০১৩তেও বেশ কিছু দিন জঙ্গলে কাটিয়ে তারপর নিজের ইচ্ছাতেই ফিরে এসেছিল ফুলমতি। তবে মস্তি কাটিয়ে নিজের ইচ্ছায় না ফিরলে জোর করাটা অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হয়ে ওঠে। ৭ বছর আগে গরুমারারই জনার্দন নামের একটি হাতি এভাবেই পালিয়ে যাওয়ার পর ঘুমপাড়ানি গুলি ছুড়ে পিলখানায় ফেরত আনা হয় কিন্তু তারপর জনার্দনকে আর বাঁচানো যায় নি। তাই ফুলমতির ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না বনাধিকারিকেরা।
তবে কুনকি হাতির এভাবে পালিয়ে যাওয়া কোন নতুন কথা নয় বলেই জানাচ্ছেন পরিবেশবিদ তথা ন্যাফ এর মুখপাত্র অনিমেষ বসু। তাঁর কথায় জলদাপাড়া, অসমের বিভিন্ন জঙ্গলে অনেক সময়েই কুনকি হাতিরা এ ভাবে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বুনো দাঁতাল এসেও ভাগিয়ে নিয়ে যায়। পরে আবার ফিরেও আসে। তবে কুনকিরা যেহেতু জঙ্গলের পরিবেশে থাকতে অভ্যস্ত নয় তাই পালিয়ে যাবার পর জঙ্গলে একটু নজরে রাখতেই হয় ওদের।