বিয়ের আসরে কনেকে ঘিরে চলছে উচ্ছ্বাস। ছবি: সন্দীপ পাল
মুম্বইয়ের অন্ধকার তালাবন্ধ খুপরি থেকে ছাদনাতলার আলো। দু’ হাত মেহেন্দি ভরা। মাঝে গড়িযে গিয়েছে ৯ বছর। মঙ্গলবার জলপাইগুড়ির অনুভব হোমে পছন্দের পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হল অনন্যার (নাম পরিবর্তিত)।
২০০৭ সালে মুম্বই থেকে উদ্ধার করা এক নাবালিকাকে পাঠানো হয় জলপাইগুড়ির অনুভব হোমে। পাচারের পরে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের নাম পরিচয় গোপন রাখা হয়। মেয়েটির আসল নামের পরিবর্তে হোমের তরফে পরিচয় দেওয়া হয় অনন্যা নামে। বাকিটা এক লড়াইয়ের কাহিনি।
খরস্রোতা রায়ডাকে নৌকা চালাত একরত্তি মেয়েটি। কাজের লোভ দেখিয়ে ফুঁসলে মুম্বই নিয়ে যায় মেয়েটিরই ঘনিষ্ঠ একজন। কয়েকমাস পরে উদ্ধার হয়ে ঠাঁই হয় জলপাইগুড়ির হোমে। বাড়ি ছেড়ে মুম্বই ঘুরে আসা মেয়েটি সারা দিন ঘরেই থাকত।
হোমের এক কর্মী জানালেন বাইরে কোনও অনুষ্ঠানে যেতে বললেও রাজি হতো না। সবসময়েই যেন ভয়ে থাকত। হোমের কর্ণধার দীপশ্রী রায় বলেন, ‘‘মনে আছে একবার হোমে সেলাই প্রশিক্ষণ ছিল। অনন্যা তাতে প্রথম হয়। সে সময় থেকেই ওকে কাউন্সেলিং করতে শুরু করি। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’’
হোমের থেকে দুরশিক্ষায় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। অনন্যা রাজি হয়। প্রথম বিভাগে পাশ করে। বিউটিশিয়ান কোর্স করানো হয় হোম থেকে। তাতেও অনন্যা প্রথম। অনুভব হোমেই কর্মী হিসেবে চাকরি শুরু করে সে। টোটো চালানো শেখে। বেশ কিছুদিন টোটোও চালায়। তারপরে ইচ্ছে হয় চার চাকা গাড়ি চালানো শেখার। অনন্যার আপত্তিতে বাধ সাধেননি হোম কর্তৃপক্ষ। মাসের মাইনে থেকে টাকা জমিয়ে সম্প্রতি সে একটি পুরোনো গাড়ি কিনেছে। স্কুল পড়ুয়াদের আনা নেওয়া করে। চাকরির সঙ্গে হাতখরচও হয়। সেই হাতখরচ জমিয়েই নিজের বিয়ের গয়না কিনেছেন। বিয়েও নিজের পছন্দেই। হোমেরই এক প্রশিক্ষকের সঙ্গে বিয়ে হল অনন্যার। পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকেও কোনও আপত্তি জানানো হয়নি।
এ দিন সকালে অনন্যাকে আশীর্বাদ করতে হোমে এসেছিল পাত্রপক্ষ। পাত্রের এক আত্মীয়ের কথায়, ‘‘বর-কণে রাজি ছিল। তাই আমাদের আপত্তির কোনও অবকাশ ছিল না।’’ অনন্যার বিয়েতে হোমে দু’দিন ধরেই উৎসব চলছে। আবাসিকরা নিজেরাই রঙিন কাগজ কেটে উঠোন সাজিয়েছে। দেওয়াল রং করেছে। কিছু ব্যক্তির আর্থিক সাহায্যে ব্যবস্থা হয়েছিল নিরামিষ ডাল, পনির, মাছ, মাংস, মিষ্টির মেনুও। সাবলম্বী অনন্যাকে আজ দিনভরই চুপচাপ দেখেছেন হোমের কর্মী-সহ আবাসিকরা। সোমবার রাতে লাগানো মেহেন্দি চর্চিত হাতের দিকে তাকিয়েই অনন্যা বললেন, ‘‘মুম্বইয়ের সেই ঘরটার কথা আজকে খুব মনে পড়ছে। সারা দিন আটকে রাখত। আলোও ঢুকত না।’’ বিয়ের সানাই তখন সদ্য থেমেছে, খোলা গলায় গান ধরেছে আবাসিকরা। হোমের শেখানো রবীন্দ্রসঙ্গীত, ‘‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।’’ হোমের উঠোন জুড়ে নানা রঙের আলো ঠিকরে পড়েছে। এক পাশে রাখা অনন্যার পুরোনো গাড়ি। অনন্যার ইচ্ছে, বউভাতের দিন ওই গাড়িতেই হোমের দিদিরা তাঁর শ্বশুরবাড়িতে আসুন।