শিলিগুড়ির জলে বিষ! — ফাইল চিত্র।
বৃহস্পতিবার ঘুম ভাঙল পরিচিতের ফোনে। সাবধান করে দিলেন, ‘‘খবরদার! কর্পোরেশনের জল খেয়ো না!’’ কারণ, আগের দিন রাতে নাকি শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব ঘোষণা করেছেন, পুরসভার জল পানের অযোগ্য! ঘুমচোখে প্রথমে অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছিল। এমনও হয় নাকি! শহরের মেয়র তাঁদেরই সরবরাহ করা জলকে পানের অযোগ্য বলছেন! কিন্তু কিছু ক্ষণ পরেই বুঝলাম, সত্যিই, বিপর্যয় দুয়ারে।
পানীয় জলের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে শহর জুড়ে। প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের বাস যে শহরটায় সেখানে এটাই স্বাভাবিক। আমি যে আবাসনে থাকি সেখানে নিজস্ব জল সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। মোটামুটি অবস্থাপন্ন মানুষের বাস। কিন্তু শিলিগুড়ি শহরে যে সমস্ত নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে সেখানে সঙ্গত কারণেই কূপ খুঁড়ে নিজস্ব জল সরবরাহের ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হয়েছে বলে শুনেছি। আজ যদি আমাদের ফ্ল্যাটে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকত, তা হলে হয়তো আমাকেও জল কিনেই খেতে হত। কারণ, সেই সঙ্গতি আমার আছে। কিন্তু আমরা ক’জন? সেই মানুষগুলি কী করছেন, যাঁদের জল কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই? তাঁদেরই বা অবস্থা কেমন, যাঁদের লাইন দিয়ে পুরসভার জলের পাউচ সংগ্রহ করার মতো সময়টুকুও নেই? এ সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলিং বেল বাজে। ওই, মালতি এল বোধহয়... ঘরে ঢোকে মালতি। বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করে সংসার টানছে মধ্য তিরিশের এই লড়াকু মেয়েটি। তাঁকেই জিজ্ঞেস করে ফেললাম,
‘‘হ্যাঁ রে, কর্পোরেশনের জল খেতে বারণ করেছে জানিস?’’
মালতির ঝটিতি জবাব, ‘‘তা আর জানব না। এই পাড়ার মুখেই তো লম্বা লাইন দেখে এলাম। সবাই নাকি জল নিচ্ছে।’’
‘‘তা, তোর জল লাগবে না? খাবি কী?’’ আবার জানতে চাই।
এ বার মালতির সাফ জবাব, ‘‘কী করব কাকু? ভোরে উঠে এত বাড়ি কাজ করতে হয়। কাজ করতে যাব, না জলের লাইনে দাঁড়াব? জল কিনে খেতে হলে আমরা কি আর বাঁচব? সব্জি কেনার পয়সা নেই, জল কী করে কিনে খাব বলো তো? কী আর করব, কর্পোরেশন যে জল দেয়, সেই জলই খাব।’’
শিলিগুড়ি শহর বা বিশ্বের অন্য কোথাও, শহরের অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষেরা কর্পোরেশনের জলের উপরেই পুরোপুরি নির্ভরশীল। বাস্তব এটাই যে, তাঁদের না আছে জল কিনে খাওয়ার সঙ্গতি, না আছে কাজ ছেড়ে বিনা পয়সার কর্পোরেশনের জলের আশায় বসে থাকার সময়। জ্বালানির দাম যা, তাতে জল ফুটিয়ে খাওয়াও অসম্ভব। মালতি কাজে ঢুকে গেল। কিন্তু বুঝিয়ে দিয়ে গেল, ঠিক কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে রোজ লড়াই করতে হচ্ছে এই মানুষগুলিকে। ওদের জন্য কি কোনও রাজনৈতিক দলের মাথাব্যথা আছে? একই অবস্থা পাড়ার ধোপা জিতেন্দ্রের। ছটের পর স্ত্রী আর ছোট দুটো ছেলেমেয়েকে ‘দেশ’ থেকে এখানে নিয়ে এসেছে। দিন আনি দিন খাই সংসার। জানতে পারলাম, জলের হাহাকারের কথা জিতেন্দ্রও শুনেছে। কিন্তু দোকান বন্ধ করে পুরসভার লাইনে দাঁড়ানো কি তাঁর পক্ষে সম্ভব? বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে পুরসভার জলের লাইনটা দেখলাম, জিতেন্দ্রকে দেখলাম না।
জলের সমস্যা শুরু হওয়ার পর বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় এই সম্পর্কিত লেখা পড়ছি। বুঝতে পারছি, খাবার জলের মান ঠিক না থাকলে কত ধরনের রোগবালাই আসে। কিন্তু পেটের রোগের দোহাই দিয়ে কি মালতি, জিতেন্দ্রদের কাজ কামাই করে জলের লাইনে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেওয়া উচিত হবে? আমার শহরে এ রকম মালতি, জিতেন্দ্রদের সংখ্যাটা কিন্তু চোখ কপালে তোলার মতো। যাঁরা জল কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন না, আবার কাজ বাদ দিয়ে পুরসভার জলের গাড়ির সামনেও লাইন দিতে পারেন না। খালি পেটে জল খেলে তো পেট ভরে না!
পানীয় জলের সমস্যা কেন হল, কবে থেকে শুরু হল, জলের পাউচে কেন জল ভরার দিনের উল্লেখ নেই— এ সব নিয়ে শিক্ষিতের চায়ের কাপে নিত্য তুফান উঠতে পারে। বুঝতে পারি, রাজনীতিতেও এটি একটি ‘প্রাসঙ্গিক ইস্যু’। কিন্তু মালতি, জিতেন্দ্রদের কাছে এই ভাবনায় সময় কাটানো বাতুলতা মাত্র। কারণ, ওঁরা খুব ভাল জানেন, কাজ কামাই করে সংগ্রহ করা পরিস্রুত পানীয় জলে পরিবারের তেষ্টা মিটবে ঠিকই, কিন্তু পেট যে খালি রয়ে যাবে!
আমার শহরে জল নিয়ে হাহাকারের খবর পাঁচকান হয়ে গিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, যাঁরা জল কিনে সমস্যা সমাধানের পথে হাঁটছেন, তাঁদের দিতে হচ্ছে অনেক বেশি দাম। তাতেও পরোয়া নেই! আন্দাজ করতে পারি, স্রেফ জল বেচে বড়লোক হয়ে যাবেন কিছু লোক। আর সেই জল গিলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন কিছু মানুষ। আত্মপ্রসাদ উপভোগ করবেন এই ভেবে যে, ভাগ্যিস, কর্পোরেশনের পচা জল খেতে হল না! আর তার মধ্যেই আবার কর্পোরেশনের জল সরবরাহ শুরু হয়ে যাবে। অতঃপর, আবার সব যে কে সেই!
এখন তো পরিচিত অনেকের কাছেই জানতে পারছি যে, দু-তিন দিন আগে থেকেই তাঁরা নাকি দেখছিলেন, নলে ঘোলা জল আসছে। তাতে নাকি গন্ধও পাচ্ছিলেন কেউ কেউ! সাধারণ মানুষ যদি তা লক্ষ করে থাকে, তা হলে পুর কর্তৃপক্ষেরও তা অজানা থাকার কথা নয়। যে কথা তাঁরা মানুষকে জানিয়ে সাবধান করলেন, তা আরও দু’দিন আগেই কি করা উচিত ছিল না? পানীয় জল নিয়ে এমন উদাসীন আচরণ কর্তব্যে অবহেলা কি না, তা নিয়ে আগামিদিনে চায়ের কাপে আরও তুফান উঠুক। কিন্তু একটা বিষয় না বলে পারছি না, জলের সমস্যার বিষয়টি কিন্তু কেবলমাত্র মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নিম্নবিত্তের পরিস্রুত জল খাওয়ার সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য নেই। তাই হয়তো, অযথা তা নিয়ে দুশ্চিন্তাও নেই। এত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চোখে আঙুল দিয়ে সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছে, এটা কিন্তু সমাজের জন্য ভাল সঙ্কেত না।
(লেখক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক)