মঙ্গলবার আলিপুরদুয়ারের পথে বাগডোগরায় মুখ্যমন্ত্রী।
বর্ষা নেমেছে। জল-জঙ্গল-পাহাড় ভাসিয়ে বৃষ্টি তাদের ভিটে-হারা করেছে।
পাহাড়ের খোঁদল, শাল-শিরীষ-ম্যাপলের গভীর ফোকর কিংবা চা-বাগানের ছায়াছন্ন নালায় তাদের চেনা ঠিকানা এখন জলে থই থই। একটু আড়ালের খোঁজে তাই বেরিয়ে পড়েছে তারা। কোথায়? উত্তরটা যদি হয়, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন বন বাংলোর চৌহদ্দি, অত্যুক্তি হবে না।
জুনের মাঝ বরাবর (১৫ জুন) পাক্কা তিন মাসের জন্য সাধারণ পর্যটকের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ডুয়ার্সের বনবাংলো। এই নিরুপদ্রব সময়ে সাপেদের অনেকেই যে বনবাংলোর আশপাশের আউটহাউস কিংবা স্তূপীকৃত টিম্বারের আড়ালে অস্থায়ী ঠিকানা বসায় তা স্থানীয় বন-বাসিন্দাদের অজানা নয়। এমনকী, সুযোগ বুঝে তাদের অনেকেই যে ফাঁক-ফোকর গলে সেঁদিয়ে যায় বনবাংলোর খাট, আলমারি কিংবা প্রলম্বিত সোফার ভাঁজে, বনকর্মীদেরও অজানা নয় তা-ও।
তিনি অবশ্য সে সবের তোয়াক্কা করেন না। বনকর্তাদের কপালে ভাঁজ ফেলে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, এই ঘোর বর্ষাতেও উত্তরবঙ্গে তাঁর দু’দিনের সফরসূচিতে প্রথম পছন্দ বনবাংলো। আষাঢ়ের ঘোর বর্ষায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দু’দিনের উত্তরবঙ্গ সফরে বেশ কয়েকটি বনবাংলোকে তাই সর্প-মুক্ত করতে হাতে হাত মিলিয়ে তাই উঠে পড়ে লেগেছে বন দফতর মায় পুলিশ-প্রশাসন।
মংপং বনবাংলোয় ১৬ জুন দেখা গিয়েছিল এই শাঁখামুঠিকে।
বনমন্ত্রী বমমন্ত্রী বিনয়কৃষ্ণ বর্মন বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন। বনবাংলোগুলিতে সাপ-খোপ, পোকামাকড়ের উৎপাত ঠেকাতে তাই ব্যবস্থা তো নিতেই হচ্ছে।” ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র করতে তাই বনকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বন উন্নয়ন নিগমের কর্তা থেকে রাজ্য পুলিশের ডিজি পদমর্যাদার অফিসার, মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক সেলের ডিরেক্টররাও। কী সেই ব্যবস্থা? বনবাংলোর আশপাশের ঝোপঝাড় সাফাই, বোতল বোতল কার্বলিক অ্যাসিড, ফিনাইল ছড়ানো, বস্তা বোঝাই ব্লিচিং পাউডার, কীটনাশক স্প্রে, কী নয়! ডাক পড়েছে সর্প বিশেষজ্ঞদেরও। তাঁরাও তদারকি করছেন সে কাজে। রাতের ঘুম শিকেয় তুলে মেন্দাবাড়ি থেকে মংপংবনবাংলোয় চলছে এই সর্প-প্রতিরোধ প্রোজেক্ট। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবাল বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক সেলের অফিসারদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখে চলেছি। পাশাপাশি, বন দফতরও যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তরাই-ডুয়ার্সের বনাঞ্চলে অন্তত ৪২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। সেই তালিকায় রয়েছে, কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়, গ্রিন ভাইপার, শাঁখামুঠি, গোখরোর মতো বিষধরেরা। আছে অন্তত তিন প্রজাতির ময়াল সাপও। এদের মধ্যে দশ-বারো রকমের সাপ রয়েছে যাদের বিষধর বললেও কম বলা হয়। সর্প বিশেষজ্ঞ মিন্টু চৌধুরী জানান, সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ডুয়ার্সের জঙ্গলে মারাত্মক বিষধর সাপই রয়েছে অন্তত বারো প্রজাতির। তিনি জানান, শঙ্খচূড় মূলত গভীর জঙ্গলের সাপ। তবে জঙ্গলে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ বেড়ে যাওয়ায় ঘাস-জঙ্গল কমে যাচ্ছে। আস্তানা হারিয়ে তাই লোকালয়ে চলে আসছে তারা। অনেক সময়ে শিকার তাড়া করতে গিয়েও সাপেরা বাংলোয় ঢুকে পড়ে বলে মনে করছেন তিনি।
মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই বনবাংলো এলাকায় সাপের আনাগোনা বেড়ে ওঠে। সে সময়ে গ্রীষ্মের প্রকোপে ঠিকানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। তবে শিকার শেষে ফিরে যায় পুরনো আস্তানাতেই। বর্ষায় চেহারা বদলে যায় ডুয়ার্সের। সেই সময়ে কার্যত বাস্তুহারা সাপেরা শিকারের পাশাপাশি খুঁজে বেড়ায় একটু স্বস্তির ঠিকানাও। আর তা করতে গিয়েই নিরুপদ্রব বাংলোগুলিতে তারা ঠাঁই নেয় অনেক সময়ে।
গত ১৬ জুন যেমন, মংপংয়ের বনবাংলোর ডাইনিং হলে ঢুকে পড়েছিল একটি শাঁখামুঠি সাপ। ডাইনিং টেবিলের নীচে ঘোরাফেরা করা একটি দশাসই টিকটিকিকে ধরে খাবার তোড়জোড় করছিল সে। চোখে পড়ায় রে রে করে ছুটে আসেন বনকর্মীরা। কোনওক্রমে তাড়ানো হয় তাকে। ঘটনাচক্রে, ওই বাংলোয় বুধবার থাকতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সে জন্য ডাইনিং হলের দরজার নীচে যে ফাঁক ছিল তা বন্ধ করা হয়েছে। বাংলোর আশেপাশের ছড়ানো হয়েছে কীটনাশক, কার্বলিক অ্যাসিড। তাতেও কি দুশ্চিন্তা যায়? মঙ্গলবার দিনরাত সেখানে থেকে তদারকি করতে দেখা গিয়েছে জনা দশেক পুলিশ কর্তাকে। গত সোমবার চালসায় পূর্ত দফতরের বাংলোতেই বা কি ঘটেছিল? ঢুকে পড়েছিল একটি ফুট বারো লম্বা শঙ্খচূড়। প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় তাকে ধরে ছেড়ে আসা হয় গরুমারার গভীর জঙ্গলে।
মিন্টুবাবু বলছেন, “বর্ষায় বনবাংলোয় থাকতে হলে বাড়তি সতর্ক হতে হবে। শোওয়ার আগে খাট, আসবাবপত্রের তলা দেখে নিতে হবে। দরজার তলায় কোনও ফাঁকফোকর রাখা যাবে না।” বনকর্তারা মরিয়া হয়ে এখন সে ব্যবস্থাই করছেন।
ছবি: বিশ্বরূপ বসাক