কাশ্মীর-ফেরত চার শ্রমিক। আব্দুল সুভান, ডালু মিয়ঁা, সোলেমান আলি ও মহম্মদ মফিজুদ্দিন। ফাইল চিত্র।
‘হালত খারাব হ্যায়। ভাগ যাও।’ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদের পর বাড়ির মালিক বা প্রতিবেশীরা তো বটেই, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাকর্মীরাও এ ভাবেই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য এক প্রকার জোর দিয়েছিলেন।
ডামাডোল পরিস্থিতিতে কাজও মিলছিল না। যোগাযোগের মাধ্যম ফোন, ইন্টারনেট সবই বন্ধ। তাই সাতপাঁচ না ভেবে জীবন বাঁচাতে ঝুঁকি ও বাড়তি টাকা খরচ করেই কাশ্মীর থেকে চারদিন বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে কোনওরকমে বাড়ি ফিরেছিলেন মালদহের গোলাপগঞ্জের সোলেমান, সুভান, মফিজউদ্দিন, ডালু, সায়েম, জিয়াউলদের মত অন্তত জনা পনেরো শ্রমিক। তারপর মাস দুই কেটেছে। এদিকে, মঙ্গলবার কাশ্মীরের কুলগামে তাঁদেরই মতো পাঁচ বাঙালি শ্রমিককে গুলি করে খুন করে জঙ্গিরা। কাশ্মীরে আর না গেলেও এই ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্কিত সোলেমানরা। তাঁরা বলছেন, সেদিন বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল তাঁদের। না হলে হয়তো এভাবে তাঁদেরও বেঘোরে প্রাণ দিতে হত।
কালিয়াচক-৩ ব্লকের গোলাপগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতের বাংলাদেশ সীমান্ত-ঘেঁষা দু’টি গ্রাম গোপালনগর ও চকমাইলপুর। গত মার্চে দুটি গ্রামের অন্তত ১৫ জন শ্রমিক কাজের জন্য গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। বারামুলা জেলার জিটি কলেজ রোডে বাড়ি ভাড়া করে তাঁরা থাকতেন। ভাড়া মাথাপিছু ৫০০ টাকা। এক ঘরে থাকতেন ডালু মিয়াঁ, সায়েম শেখ, রিটু শেখ, পল্টু মিয়াঁ-সহ সাতজন। আর এক ঘরে থাকতেন সোলেমান আলি, তাঁর ছেলে সুভান ও মহম্মদ মফিজুদ্দিন এবং অন্য দু'জন। তাঁরা নিজেরাই রান্না করে খেতেন। যে ঘরে থাকা সেই ঘরেই রান্না। কাশ্মীরে তাঁরা মূলত আপেল বাগান পরিচর্যা, ফুলের বাগান চাষ ও পরিচর্যা, পাহাড়ের ঢালে আনাজ চাষ, পাকা বাড়ি তৈরির মতো কাজ করতেন। মজুরি মাথাপিছু মিলত সাড়ে ৪০০ টাকা। কিন্তু ৩৭০ ধারা রদের পর তাঁরা কাশ্মীর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। এখন মজুরি কম হলেও মালদহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তারা দিনমজুরের কাজ করছেন।
মঙ্গলবার কাশ্মীরের কুলগ্রামে জঙ্গিদের হাতে পাঁচ বাঙালি শ্রমিকের মৃত্যুর পর তারা আতঙ্কিত। চকমাইলপুরের বাসিন্দা সোলেমান বলেন, ‘‘৩৭০ ধারা রদের পর আমরা কোনওরকমে পালিয়ে এসেছিলাম। আমরা যেখানে থাকতাম সেই বারামুলার জিটি রোড থেকে কুলগ্রাম প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। জঙ্গিরা আমাদের উপরেও হামলা করতে পারত। আমরাও ওখানে একঘরে পাঁচ-সাতজন করে থাকতাম। থাকলে হয়তো বেঘোরে প্রাণ দিতে হত।’’ গোপালনগরের ২০ বছরের যুবক ডালু মিয়াঁ বলেন, ‘‘রুটিরুজির জন্যই পাড়ি দিয়েছিলাম সুদূর কাশ্মীরে। কিন্তু অগস্টের পাঁচ তারিখের পর থেকে পরিস্থিতি এমন ঘোরালো হয়েছিল যে কোনও কাজ তো দূরের কথা, বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাচ্ছিল না। বাড়ির মালিক সাবির ডার আমাদের সাতজনকেই ডেকে জানিয়ে দেন, ‘হালত খারাব হ্যায়। ভাগ যাও।’ একই কথা সেনাদেরও ছিল। তাই সেসময়ই আমরা পালিয়ে আসি। এবার দেখলাম আমাদের মত পাঁচ শ্রমিককে জঙ্গিরা তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারল। এটা আমাদের সঙ্গেও হতে পারত।’’
গোপালনগরের পঞ্চায়েত সদস্য হারাধন রজক বলেন, ‘‘আমার সংসদের ১০ জন বাসিন্দা কর্মসূত্রে কাশ্মীরে ছিল। কিন্তু গত প্রায় দু'মাস আগে তারা ফিরে এসেছেন। তারা এখনও সেখানে থাকলে কী হত, কে জানে!’’